গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর পূর্ব বিটে দখল বাণিজ্য, ডিসিএফের তদন্তে মিলল ঘুষের প্রমাণ

নিজস্ব প্রতিবেদক : গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর রেঞ্জের রাজেন্দ্রপুর পূর্ব বিটে বনভূমি দখল ও লেনদেনের ঘটনা তদন্ত করেছে বন বিভাগ। এতে মিলেছে ঘুষ-দুর্নীতির প্রমাণ।
কেন্দ্রীয় বন অঞ্চলের উপ-বন সংরক্ষক (ডিসিএফ) মোস্তাফিজুর রহমান গত ১২ ডিসেম্বর সরেজমিনে দিনব্যাপী তদন্ত করেন। এ সময় অন্তত দুজন দখলদার ঘুষ লেনদেনের লিখিত সাক্ষ্য দেন।
এর আগে দখল বাণিজ্যের ওপর সাপ্তাহিক ঘটনার আড়ালের প্রিন্ট ও অনলাইন ভার্সনে একাধিক সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। পরে প্রধান বন সংরক্ষক (সিসিএফ) আমীর হোসাইন চৌধুরী তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।

আরও পড়ুন : গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর পূর্ব বিটে দখল বাণিজ্য ধামাচাপার পাঁয়তারা

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তদন্ত কর্মকর্তা ইজ্জতপুর ও কাফিলাতলী এলাকায় গিয়ে সংরক্ষিত বনভূমি দখল করে নির্মিত স্থাপনাগুলো দেখেন এবং দখলকারীদের সঙ্গে কথা বলেন। দখলকারীরা মুখ খোলায় চাপে পড়েন বিট কর্মকর্তা কে বি এম ফেরদৌস।
ইজ্জতপুর রেলক্রসিংয়ের পশ্চিম পাশে সুফল প্রকল্পের চারা তুলে প্রায় পাঁচ গন্ডা বনভূমি দখল করে লোহার অ্যাঙ্গেল দিয়ে তিন রুমের বাড়ি নির্মাণ করেছেন সিরাজুল ইসলাম। তিনি তদন্ত কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে জানিয়েছেন, বিট কর্মকর্তা ফেরদৌস তার কাছ থেকে প্রথমে ৪০ হাজার টাকা ও পরে দুই দফায় ২০ হাজার টাকা করে মোট ৮০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছেন।
ইজ্জতপুর স্কুলের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে নির্মাণাধীন ব্লক ইট কারখানার মালিক শাহাদাত হোসেন বনভূমি দখল করে মালবাহী গাড়ি চলাচলের জন্য রাস্তা নির্মাণ করেন। তিনি তদন্ত কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে জানিয়েছেন, বিট কর্মকর্তা ফেরদৌস স্থানীয় এক ব্যক্তি ও দুজন বনপ্রহরীর উপস্থিতিতে তার কাছ থেকে এক লাখ ১০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছেন।
ইজ্জতপুর বাজারের পূর্ব পাশে দখলদার সাইদুল ইসলামের কাছ থেকে চার রুমের মাটির বাড়িসহ প্রায় ২০ শতাংশ বনভূমি ১০ লাখ টাকায় কিনে নিয়েছেন গাজীপুরের মামুন। পরে টিনের বাউন্ডারি, বারান্দা, ভিটিতে টাইলস স্থাপন ও রাজকীয় গেট নির্মাণের কাজ শুরু হয়। বিল্লাল মাস্তান নামের এক দালাল তাকে সার্বিক সহযোগিতা করেন।
ঘটনার আড়ালে-তে প্রতিবেদন প্রকাশের পর টিনের বাউন্ডারি, বারান্দা ও গেটের পিলার ভেঙে দেয় বিট অফিস। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে কোন মামলা করা হয়নি।
সাইদুল ইসলাম তদন্ত কর্মকর্তাকে বলেছেন, তিনি বাড়িটি বিক্রি করেননি, ভাড়া দিয়েছেন। বিল্লাল মাস্তান বলেছেন, তিনি বাড়ির বিষয়ে কিছুই জানেন না।
স্থানীয়রা ঘটনার আড়ালে-কে বলেছেন, ওই বাড়ি থেকে বিট অফিসে এক-দেড় লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। বনভূমিসহ বাড়িটি বিক্রি ও বিল্লাল মাস্তানের মধ্যস্থতার কথা সবাই জানেন। মামুন বর্তমানে বিল্লাল মাস্তানের মেয়ের জামাই। তারা মামলা থেকে বাঁচতে বাড়ি বিক্রি ও লেনদেনের বিষয় গোপন করেছেন।
বাতেন ডাক্তারের বাড়ির পাশে বনায়নের শতাধিক চারা বিনষ্ট করে প্রায় ১৫ শতাংশ বনভূমি দখল করেছেন সৌদি প্রবাসী খাইরুল বাশার রিপনের স্ত্রী ইয়াসমিন। ঘটনার আড়ালে-তে প্রতিবেদন প্রকাশের পর ইয়াসমিন সেখানে আর কিছু না করায় ঝোপের সৃষ্টি হয়েছে। বিট অফিসও কোন ব্যবস্থা নেয়নি।
ইজ্জতপুরের পুরাতন কবরস্থানের পাশে বন বিভাগের নামে গেজেটভুক্ত সিএস ৫৮ নং দাগের প্রায় পাঁচ গন্ডা জমি দখল করে তিন রুমের পাকা বাড়ি নির্মাণ করেছেন ব্যবসায়ী কদম আলী। এই বাড়ি থেকে বিট অফিস দুই দফায় ৮০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছে বলে অভিযোগ।
তবে কদম আলী তদন্ত কর্মকর্তার কাছে লেনদেনের কথা স্বীকার করেননি। তিনি দাবি করেছেন, ওই জমি তার জোত। ডিমারকেশনের জন্য আবেদন করা হয়েছে।
অথচ সিএস ৫৮ নং দাগ পার্ট নয়, সম্পূর্ণ গেজেটভুক্ত। কয়েক মাসে বাড়িটির কাজ সম্পন্ন হলেও বিট অফিস প্রতিরোধ বা উচ্ছেদ করেনি। অদ্যাবধি কোন মামলাও হয়নি।
সংশ্লিষ্ট একজন বলেছেন, কদম আলী রেঞ্জ কর্মকর্তা জুয়েল রানার পরামর্শে সম্প্রতি ডিমারকেশনের জন্য আবেদন করেছেন। যদিও দাগটি সিএস রেকর্ডে পার্ট না থাকায় ব্যক্তি নামে ডিমারকেশনের কোন সুযোগ নেই। এটা স্পষ্টত বন নিয়ে খামখেয়ালি।
এ ছাড়া রেঞ্জ অফিসের পাশে সিএস ১৭৭ নং দাগের বনভূমি দখল করেছেন স্থানীয় ব্যবসায়ী শরাফত আলী। আলোকিত নিউজে প্রতিবেদন প্রকাশের পর দুবার অভিযান চালিয়ে কিছু বনভূমি উদ্ধার ও চারা রোপণ করা হয়েছে।
এখনো ভাড়া দেওয়া টিনশেড বাড়িসহ আনুমানিক পাঁচ শতাংশ বনভূমি শরাফতের দখলে রয়েছে। অন্যদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও তার বিরুদ্ধে কোন মামলা হয়নি।
একাধিক ওয়াকিবহাল সূত্র জানায়, তদন্তে লেনদেনের কথা না বলার জন্য বিট কর্মকর্তা ফেরদৌস বিভিন্নজনকে আগে থেকেই শাসিয়েছেন। মামলার ভয়ে কেউ কেউ সত্য চেপে গেছেন। নয়তো তার ঘুষ বাণিজ্যের আরও তথ্য বেরিয়ে আসতো।
সূত্র আরও জানায়, বিট কর্মকর্তা ফেরদৌস গত ফেব্রুয়ারিতে রাজেন্দ্রপুর পূর্ব বিটে যোগ দেওয়ার কিছুদিন পর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। এর আগে বিট কর্মকর্তা আইয়ুব খানও বেপরোয়া ছিলেন। বন রক্ষায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থার দৃষ্টান্ত জরুরি।
জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান ঘটনার আড়ালে-কে বলেন, এখনো প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়নি। প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হচ্ছে।

আরও খবর

Back to top button