কালিয়াকৈরের জাথিলা বিটে বাড়ছে দখল বাণিজ্য, উজাড় হচ্ছে বন
ঘটনার আড়ালে প্রতিবেদন : গাজীপুরের কালিয়াকৈরের কাঁচিঘাটা রেঞ্জের জাথিলা বিটে দখল বাণিজ্য আবার জমে উঠেছে।
বনভূমি দখল করে অবাধে স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। গাছ কেটে উজাড় করা হচ্ছে বন। লেনদেনে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন কর্মকর্তারা।
এর আগে বিষয়টির ওপর গত বছরের ২৮ নভেম্বর ঘটনার আড়ালে-তে একটি সচিত্র প্র্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ নিয়ে চলে তোলপাড়।
পরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বন অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় অঞ্চলের উপ-বন সংরক্ষক ড. আবদুল আউয়াল গত ১৭ ফেব্রুয়ারি সরেজমিনে তদন্ত করেন।
এ সময় সংরক্ষিত বনভূমি দখল করে দোকানপাট ও বাড়িঘর নির্মাণের সত্যতা মেলে। কিন্তু অদ্যাবধি বনভূমি উদ্ধারসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এই সুযোগে আবার দখল ও গাছ কাটা বেড়েছে। বাণিজ্যে মেতেছে বিট অফিস।
জাথিলা বিট অফিসের উত্তরে শিমুলিয়া এলাকায় বনভূমি দখল করে নতুন বাড়ি নির্মাণ করেছেন চাঁন মিয়ার ছেলে রুবেল। এ জন্য কাটা হয়েছে গজারি ও আকাশমনি বাগানের কয়েকটি গাছ। একই এলাকায় বনভূমিতে চার রুমের বাড়ি নির্মাণ করেছেন তমছের আলীর ছেলে জুয়েল।
শিমুলিয়ায় বনভূমিতে নবনির্মিত রুবেলের বাড়ি
কালিয়াকৈর-ফুলবাড়িয়া সড়ক থেকে বনের ভেতর দিয়ে আনুমানিক ১০০ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি রাস্তা তৈরি করেছেন জুমান। এ জন্য কাটা হয়েছে কয়েকটি গজারি ও আকাশমনি গাছ।
৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর জুমান সেখান দিয়ে রাস্তা তৈরির চেষ্টা করলে বিট অফিস বাধা দেয়। বর্তমান বিট কর্মকর্তা শরিফ উদ্দিন দায়িত্ব নেওয়ার পর তা সম্পন্ন হয়।
গত মাসে আমতৈল বিরানব্বই এলাকার আকাশমনি প্লট থেকে আবদুর রহিম, জুমান ও রাসেল কয়েকটি গাছ কেটে পাচারের চেষ্টা করেন। খবর পেয়ে বিট অফিসের লোকজন গিয়ে গাছ জব্দ ও পাচারকারীদের একটি মোটরসাইকেল আটক করে অফিসে নিয়ে যান।
এক দিন পর মোটরসাইকেলটি ছেড়ে দেওয়া হয়। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়নি। এতে ৪০-৫০ হাজার টাকা লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ।
বড়চালা বাজারের পূর্ব পাশে জবর দখল সূত্রে ২০ শতাংশ বনভূমি ব্যবসায়ী আবুল হোসেনের কাছে পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি করেন নিয়ত আলী। গত ৪ আগস্ট সেখানে তিনটি দোকান নির্মাণের কাজ শুরু হলে বন কর্মকর্তারা গিয়ে বাধা দেন। তখন দস্যুদের হামলায় সাবেক বিট কর্মকর্তা মাসুম উদ্দিন আহম্মেদ ও সাবেক রেঞ্জ কর্মকর্তা সৈয়দ আমিনুর রহমানসহ কয়েকজন আহত হন।
এ ঘটনায় ১৫ জনের বিরুদ্ধে কালিয়াকৈর থানায় মামলা করা হয়। এত কিছুর পরও দোকানগুলো উচ্ছেদ না করে প্রধান আসামি আবুল হোসেনকে আবার স্থাপনা নির্মাণের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে মাটি ফেলে নিচু অংশ ভরাট করা হয়েছে।
গজারিয়াচালা-আমতৈল এলাকায় সম্প্রতি বনভূমি দখল করে একটি বড় ঘর নির্মাণ করেছেন রিয়াজুল। গজারিয়াচালা এলাকায় বনভূমিতে ঘর তুলেছেন বনপ্রহরী আবদুল মোতালেবের ছেলে আমিনুল ও আবুল হোসেনের ছেলে আবদুল্লাহ। আমিনুল এর আগে বড়চালা বাজারের বনভূমিতেও একটি দোকান করেছেন।
মজিদচালা বাজারের পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে একটি নতুন সমিল স্থাপন করেছেন স্থানীয় জুলহাসের ছেলে আলহাজ। সমিলের পাশেই বন। অবৈধ এই সমিলে চোরাই গাছ চেরাই করার অভিযোগ রয়েছে।
মজিদচালা বাজারের পাশে আলহাজের নতুন অবৈধ সমিল
মজিদচালা বাজারের প্রায় এক কিলোমিটার উত্তরে নিজ বাড়িতে সমিল স্থাপন করেছেন মৃত ওয়াহাব মিয়ার ছেলে শামীম। সমিলের অদূরে বনাঞ্চল। অবৈধ এই সমিলে বেশি চেরাই করা হয় গজারি গাছ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আইন লঙ্ঘন করে গড়ে ওঠা সমিল দুটি থেকে বিট অফিস মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। মাঝে-মধ্যে অবৈধ গাছের গাড়ি ধরা পড়লেও টাকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। এর ফলে গজারি ও আকাশমনি বাগানের গাছ চুরি বেড়েছে।
সূত্র আরও জানায়, অপরাধীরা অফিস সহায়ক আবদুর রাশেদের মাধ্যমে বিট কর্মকর্তার সঙ্গে লেনদেন করেন। তিনি দাবিকৃত টাকা পেলেই বনভূমিতে স্থাপনা নির্মাণের সুযোগ করে দেন। গত ৫ আগস্টের পর তাকে কালিয়াকৈর রেঞ্জের বারুইপাড়া বিটে বদলির আদেশ হলেও রিলিজ দেওয়া হচ্ছে না।
অপরদিকে আমতৈল বাজারের পূর্ব পাশে ১০ বিঘা জমিতে মাটি ও বালু ভরাট করছে ইনোভ্যু কেমিক্যালস লিমিটেড। স্পটটির দক্ষিণ ও পশ্চিম পাশ ঘেঁষে বনভূমি। ইতিমধ্যে অর্ধেকের বেশি অংশ ভরাট করা হয়েছে। সেখানে ডিমারকেশনের কোন খুঁটি পাওয়া যায়নি।
ডিমারকেশন ছাড়াই বন ঘেঁষে ইনোভ্যু কেমিক্যালসের মাটি ও বালু ভরাট
স্থানীয়রা জানান, প্রস্তাবিত কারখানাটির মালিক বিট কর্মকর্তাকে হাত করে ভরাট কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে বনের কিছু অংশ দখলের আশঙ্কা রয়েছে। আইন-কানুন প্রতিপালন না করায় ঝুঁকির মুখে পড়ছে বনজ সম্পদ।
বিট কর্মকর্তা শরিফ উদ্দিন জাথিলা বিটের অতিরিক্ত দায়িত্বে আছেন। তার মূল পোস্টিং কাঁচিঘাটা সদর বিট। দুটি বিটেই তিনি বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।
এ ব্যাপারে বিট কর্মকর্তা শরিফ উদ্দিন ঘটনার আড়ালে-কে বলেন, তিনি পাঁচ মাস ধরে জাথিলা বিটের দায়িত্বে আছেন। দায়িত্ব নেওয়ার সময় প্রায় ১০০ স্থাপনার কাজ চলমান ছিল। পরে তা সম্পন্ন হয়েছে। বড় বিট, তার সময়েও স্থাপনা হতে পারে।
ইনোভ্যু কোম্পানির বালু ভরাট প্রসঙ্গে বিট কর্মকর্তা বলেন, আমি কয়েক দিন আগে এনওসির প্রতিবেদন দিয়েছি। ডিমারকেশন হবে। এখানে আমাদের কিছু করার নেই।
সমিলের বিষয়ে জানতে চাইলে শরিফ উদ্দিন বলেন, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিন আগে সমিল দুটি করা হয়েছে। শামীমের সমিল থেকে দুই ভ্যান আকাশমনি গাছও জব্দ করা হয়েছিল। তবে পিওআর মামলা দেওয়া হয়নি, ইউডিআর মামলা দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন : কালিয়াকৈরের জাথিলা বিটে বন কেটে অবাধে গড়ে উঠছে দোকানপাট ও বাড়িঘর