কাপাসিয়া এসিল্যান্ড অফিসে ‘দুর্নীতির রাজা’ মাহবুব সিন্ডিকেটের রামরাজত্ব
ঘটনার আড়ালে প্রতিবেদন : ওরা তিনজন। পদে কর্মচারী হলেও দাপট দোর্দণ্ড। নানা দুর্নীতির চর্চায় সিদ্ধহস্ত। মেতেছেন আখেরি বাণিজ্যে। পূর্বের খুঁটির জোর এখনো বহাল। গুরুতর অভিযোগ উঠলেও কিছুই হয় না।
আলোচিত এই তিন ব্যক্তি হলেন গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলা ভূমি অফিসের মিউটেশন কাম সার্টিফিকেট সহকারী মাহবুবুর রহমান, নাজির কাম ক্যাশিয়ার ফারিয়া সরকার ববি ও সায়রাত সহকারী শিব্বির আহমেদ। তারা একই পদায়ন আদেশে ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি একত্রে যোগদান করেন। এরপর প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও কেউ তাদেরকে অন্যত্র বদলির দুঃসাহস দেখাননি।
অথচ ভূমিসেবায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকল্পে সরকারি কর্মচারীদের প্রতি তিন বছর অন্তর বদলির বিধান রয়েছে। গত ৫ জানুয়ারি ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব (মাঠ প্রশাসন-১) হেমন্ত হেনরী কুবি স্বাক্ষরিত পত্রেও বিষয়টি প্রতিপালনের জন্য কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কাপাসিয়া উপজেলা ভূমি অফিসে দীর্ঘদিন ধরে ঘুষ-দুর্নীতির সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট রয়েছে। এর নেতৃত্বে আছেন নামজারি সহকারী মাহবুবুর রহমান। সিন্ডিকেটের দুই পুরনো সদস্য হলেন নাজির ফারিয়া সরকার ববি ও সায়রাত সহকারী শিব্বির আহমেদ। অফিসটিতে যখন যে এসিল্যান্ড আসেন, তারা নামজারি বাবদ ঘুষের রেট নির্ধারণে শলাপরামর্শ দিয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন।
বর্তমানে আটটি ইউনিয়ন ভূমি অফিস থেকে মাসে প্রায় ৮০০ নামজারি ও জমাভাগের প্রস্তাব উপজেলা ভূমি অফিসে জমা হয়। নামজারির ধরন ও জমির পরিমাণ অনুযায়ী তিন হাজার টাকা থেকে শুরু করে লাখ টাকা লেনদেন হয়। জমির পরিমাণ বেশি হলে নামজারি সহকারী মাহবুবুর রহমান ও কানুনগো মোহাম্মদ হান্নানকে অতিরিক্ত পাঁচ হাজার টাকা করে দিতে হয়। টাকা না পেলে নানা কারণ দেখিয়ে আবেদন নামঞ্জুর করা হয়।
অভিযুক্তরা নিজেরা আবেদনকারীদের সঙ্গে লেনদেন বা চুক্তি করেন কম। ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কর্মচারী ও দালালদের মাধ্যমে লেনদেন বেশি হয়। এসিল্যান্ড অফিসে এখন ঘুষের ক্যাশিয়ার হিসেবে আছেন উমেদার রাজিব ও নৈশপ্রহরী পলাশ।
এ ছাড়া বিভিন্ন মিসকেস ও সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত ডিমারকেশনেও লেনদেন ওপেন সিক্রেট। এসব বাণিজ্যের মাধ্যমে তারা বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হচ্ছেন। বেশির ভাগ সেবাপ্রার্থীকে পোহাতে হচ্ছে হয়রানি ও ভোগান্তি।
বিষয়টির ওপর গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ঘটনার আড়ালে-তে একটি তথ্যবহুল প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ নিয়ে চলে তোলপাড়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সোচ্চার না হওয়ায় অভিযুক্তদের দৌরাত্ম্য আরও বেড়ে যায়। সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. নূরুল আমিনও সিন্ডিকেটপ্রীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন।
ধরা পড়েও বহাল মাহবুব : মিউটেশন কাম সার্টিফিকেট সহকারী মাহবুবুর রহমান বড় বড় দুর্নীতির চুক্তি নেন। ইতিপূর্বে সরকারি সম্পত্তি আত্মসাতে সহযোগিতার একটি ঘটনায় তিনি ধরা পড়ে যান। তদন্তে তা প্রমাণিতও হয়। তবুও রয়েছেন বহাল তবিয়তে।
উপজেলার রায়েদ ইউনিয়নের বাগেরহাট মৌজার সিএস ৪১২ নং দাগের ২ একর ৯৭ শতাংশ জমি সরকারের ১ নং খাস খতিয়ানভুক্ত। এই জমি ১৯৬৭ সালে মতিউর রহমানের নামে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। দলিল নম্বর ৬৪১৯। পরে বন্দোবস্তের শর্ত ভঙ্গ করে পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ১৯৬৮ সালে তা শামসুল হক চৌধুরীর কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। দলিল নম্বর ৪৮। পরে পর্যায়ক্রমে একাধিক ব্যক্তি পৃথক নামজারিমূলে জমির মালিক হন।
এ ঘটনায় স্থানীয় কবির হোসেন ২০২০ সালে জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন। তদন্ত শেষে উপজেলা ভূমি অফিসে একটি মোকদ্দমা দায়ের হয়। মোকদ্দমা নম্বর ৭/২০২১। পরে তৎকালীন এসিল্যান্ড রুবাইয়া ইয়াসমিন ২০২১ সালের ২২ ডিসেম্বর রায় দেন।
রায়ে বলা হয়, বন্দোবস্তের শর্ত ভঙ্গের দায়ে মতিউর রহমানের অনুকূলে বন্দোবস্তকৃত এবং পরবর্তীতে সৃষ্ট সকল জোত বাতিল করে ১ নং খাস খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত করা হলো। এ ছাড়া তর্কিত সম্পত্তি বিল শ্রেণির। যা জনসাধারণের ব্যবহার্য।
নথি উপস্থাপনকারী হিসেবে এসিল্যান্ডের এই আদেশ বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়ে মাহবুবুর রহমানের ওপর। কিন্তু তিনি আদেশ বাস্তবায়ন করেননি। এসিল্যান্ড রুবাইয়া ইয়াসমিন বদলি হয়ে চলে গেলে মাহবুবুর রহমান বিবাদী পক্ষের সঙ্গে মোটা অঙ্কের চুক্তি করেন। পরে নিষ্পত্তিকৃত নথি থেকে রায়ের কপি সরিয়ে ফেলে পুনরায় মোকদ্দমা চালু করা হয়।
মাহবুবুর রহমান অভিযোগকারী ব্যক্তিকে ২০২২ সালের ১২ অক্টোবর সকালে উপজেলা ভূমি অফিসে শুনানিতে উপস্থিত থাকার জন্য নোটিশ দেন। এরপর নানা কৌশলে চলে সময়ক্ষেপণ। এক পর্যায়ে অভিযোগকারী কবির হোসেন গত ৩০ সেপ্টেম্বর মাহবুবুর রহমানের প্রতারণা ও সরকারি সম্পত্তি বেহাতের ঘটনায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন।
পরে সাবেক ইউএনও এ কে এম লুৎফর রহমান নোটিশ জারি করে তার কার্যালয়ে উভয় পক্ষের শুনানি গ্রহণ করেন। শুনানি ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রাদি পর্যালোচনা শেষে তিনি মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য গত ৭ নভেম্বর জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করেন। যার স্মারক নম্বর ২০২৪-৯১৫। কিন্তু গত ছয় মাসেও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পেশকার মাহবুবুর রহমান সরকারি সম্পত্তি সম্পর্কিত বিবিধ মোকদ্দমার আদেশ বাস্তবায়ন না করে ও আদেশের বিষয়টি গোপন করে পুনরায় তা চলমান রাখেন। তিনি এর কোন ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারেননি। যা তার অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে অবহেলা এবং সরকারি কর্মচারী বিধিমালা ২০১৮-এর পরিপন্থী।
অপরদিকে মাহবুবুর রহমানকে ‘ঘুষখোর’ আখ্যা দিয়ে গত ১৪ জানুয়ারি ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন অবসরপ্রাপ্ত বিজিবি কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর সরকার। পরে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের রাজস্ব শাখা থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু গত প্রায় তিন মাসেও কোন অগ্রগতির খবর পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে মিউটেশন কাম সার্টিফিকেট সহকারী মাহবুবুর রহমান ঘটনার আড়ালে-কে বলেন, ওই বন্দোবস্ত বাতিল হয়নি, মামলা চলমান আছে। এসিল্যান্ড বন্দোবস্ত বাতিল করতে পারেন না, বাতিল করবেন জেলা প্রশাসক।
ববি বেসামাল : নাজির কাম ক্যাশিয়ার ফারিয়া সরকার ববি বাণিজ্যে বেপরোয়া। তিনি সেবাপ্রার্থীদের সঙ্গে আচরণেও অনেকটা বেসামাল। এ নিয়ে ক্ষোভের অন্ত নেই।
আগে নামজারি অনুমোদনের পর উপজেলা ভূমি অফিসের নাজিরের কাছ থেকে ডিসিআর কাটতে হতো। সরকারি ফি ১১০০ টাকা। কিন্তু নাজির ফারিয়া সরকার ববি নিতেন ১৩০০ টাকা। শত শত ডিসিআর থেকে ২০০ টাকা করে বেশি আদায় করায় মাসে তার ব্যাগে ঢুকতো প্রায় দেড় লাখ টাকা।
নাজির ফারিয়া সরকার ববি নামে-বেনামে বিপুল অর্থ-সম্পদ গড়ে তুলছেন। তিনি গাজীপুর মহানগরীর অভিজাত এলাকা মধ্য ছায়াবিথীর ট্রাস্ট টাওয়ারের তৃতীয় তলায় একটি ফ্ল্যাট কিনে বসবাস করছেন। বাড়ি নম্বর ডি-১৫০। ফ্ল্যাটটি কেনায় ব্যয় হয়েছে প্রায় ৪০ লাখ টাকা।
এ ছাড়া ফারিয়া সরকার ববি নগরীর মারিয়ালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পূর্ব দিকে নাওভাঙা রাস্তার উত্তরে আলী নেওয়াজের বাড়ির পাশে তিন কাঠার একটি দামি প্লট কিনেছেন। সেখানে ভবন নির্মাণের প্রস্তুতি চলছে।
এ ব্যাপারে নাজির কাম ক্যাশিয়ার ফারিয়া সরকার ববি ঘটনার আড়ালে-কে বলেন, ট্রাস্ট টাওয়ারে তার ফ্ল্যাট নেই। তিনি সেখানে থাকেনও না। মারিয়ালীতেও তার জমি নেই।
বিষয়টি নিয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ কায়সার খসরুর সঙ্গে মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি কল ধরেননি।
আরও পড়ুন : কাপাসিয়া এসিল্যান্ড অফিস ‘ঘুষ সিন্ডিকেটে’ বন্দী, ব্যাপক ভোগান্তি