গাজীপুর রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সের রেকর্ড রুম লুটে খাচ্ছেন দুদকের আসামি জাহাঙ্গীর

ঘটনার আড়ালে প্রতিবেদন : গাজীপুর জেলা রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের রেকর্ড রুমে ঘুষ-দুর্নীতি বেপরোয়া আকার ধারণ করেছে। কাউকে তোয়াক্কা করছে না সংঘবদ্ধ চক্র।
বহুল আলোচিত সাব-রেজিস্ট্রার জাহাঙ্গীর আলম দুদকের একাধিক মামলার আসামি হয়েও দাপট দেখাচ্ছেন। জেলা রেজিস্ট্রার সাবিকুন নাহার তাকে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করছেন বলে অভিযোগ।
রেকর্ড রুমের ঘুষ বাণিজ্য নিয়ে গত ২৫ সেপ্টেম্বর ঘটনার আড়ালে-তে একটি তথ্যবহুল প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে চলে ব্যাপক তোলপাড়। পরে ওপর মহলে তদবির করে তা ধামাচাপা দেওয়া হয়। পাশাপাশি ঘুষের রেট আরও বাড়িয়ে নিজের ক্ষমতা জাহির করেন জাহাঙ্গীর আলম।
সরেজমিনে প্রাপ্ত তথ্যমতে, নগরীর মারিয়ালী এলাকায় নির্মিত রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সের চতুর্থ তলায় জমির দলিলের সইমোহর নকল তোলার রেকর্ড রুম। সেবাপ্রার্থীরা নকল তুলতে তল্লাশিকারকদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ২০ টাকার কোর্ট ফি ও স্ট্যাম্প দিয়ে আবেদন করা হয়। একই সঙ্গে রেকর্ড কিপারের কাছে প্রতি নকলে জমা দিতে হয় ১৫৫০ টাকা।
জমির রেজিস্ট্রিকৃত মূল্য ও পাতা অনুযায়ী নকলপ্রতি গড়ে সরকার রাজস্ব পায় ৪০০-৫০০ টাকা। বাকি ১০০০ থেকে ১১০০ টাকা ঘুষ হিসেবে জমা হয়।
রেকর্ড কিপার শামীমা সুলতানার চেয়ারের পাশে বসে একাধিক নকলনবিশ তল্লাশিকারদের কাছ থেকে টাকা আদায় করেন। পরে রেকর্ড কিপারের কাছে হিসাব বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
রেকর্ড রুমের দায়িত্বে আছেন গাজীপুর সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের সাব-রেজিস্ট্রার জাহাঙ্গীর আলম। তিনি গত বছরের ১৩ মার্চ গাজীপুরে যোগদান করেন। তাকে যুগ্ম সাব-রেজিস্ট্রি অফিসেরও অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
যুগ্ম অফিসসহ গাজীপুর রেকর্ড রুমে দৈনিক ৪০০-৫০০ নকলের আবেদন জমা পড়ে। মাসে জমাকৃত আবেদনের সংখ্যা দাঁড়ায় আট হাজার থেকে ১১ হাজার। নকলগুলো থেকে গড়ে ১০০০ টাকা করে মাসে অন্তত এক কোটি টাকা ঘুষ আদায় করা হয়।
স্বাক্ষর বাবদ নকলের সংখ্যা গুণে এই বিপুল টাকার বড় অংশ নেন সাব-রেজিস্ট্রার জাহাঙ্গীর আলম। বাকি টাকা রেকর্ড কিপারসহ অন্যদের মধ্যে পদ অনুযায়ী ভাগ-বাটোয়ারা হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, রেকর্ড রুমে আগে রেট ছিল ১১০০ টাকা। সাব-রেজিস্ট্রার জাহাঙ্গীর আলম গত বছরের জুলাইয়ে ২০০ টাকা বাড়িয়ে ১৩০০ টাকা নির্ধারণ করেন। পরে তল্লাশিকারক সমিতি তাদের ফান্ডে কিছু সহযোগিতার দাবি জানালে আরও ৫০ টাকা বাড়ানো হয়।
মারিয়ালীতে অফিস স্থানান্তরের পর আরও ২০০ টাকা বাড়িয়ে ১৫৫০ টাকা রেট করে দেন সাব-রেজিস্ট্রার জাহাঙ্গীর আলম। নতুন ধার্যকৃত ২০০ টাকার মধ্যে উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসগুলো থেকে ২০১০ সালের আগের বালাম বই আনা বাবদ ১৫০ টাকা ও অফিস খরচ বাবদ ৫০ টাকা ধরা হয়েছে।
অথচ রেকর্ডপত্র ব্যবস্থাপনা ও অফিস পরিচালনাগত খরচের জন্য সরকারি বরাদ্দ রয়েছে। সেবাপ্রার্থীদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নিয়ে এসব করার কোন সুযোগ নেই।
সাব-রেজিস্ট্রার জাহাঙ্গীর আলমের গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রামে। তিনি চলতি বছরের ২০ নভেম্বর অবসরে যাবেন। তাই ‘এ’ গ্রেডের এই কর্মকর্তা শেষ সময়ের বাণিজ্যে মেতে উঠেছেন।
কয়েকজন তল্লাশিকারক ও দলিল লিখক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, অফিসে দুর্নীতি ও ভোগান্তির শেষ নেই। সাব-রেজিস্ট্রারের প্রশ্রয় পেয়ে উমেদাররাও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। তাদের মধ্যে সোহেল, কাশেম, রিপন ও রাব্বিকে ৫০০-১০০০ টাকা করে না দিলে পুরনো বালাম বই পাওয়া যায় না।
তারা আরও বলেন, জনসাধারণকে আগে কম টাকায় দলিলের নকল দেওয়া যেত। ঘুষের রেট বাড়ায় টাকা বেশি নিতে হচ্ছে। এখন তিন হাজার টাকার নিচে নিলে পারিশ্রমিক কমে যায়।
দুদকের মামলা সমাচার :
সাব-রেজিস্ট্রার জাহাঙ্গীর আলম একজন চিহ্নিত দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়েরকৃত দুটি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রথম মামলা হয়েছে ২০১৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। ময়মনসিংহের ভালুকা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে থাকাকালীন সময়ে তিনি মৃত ব্যক্তিকে জীবিত ও বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তিকে দেশে উপস্থিত দেখিয়ে কমিশন গঠনের মাধ্যমে ৯ কোটি টাকা মূল্যের জমি রেজিস্ট্রি করেন।
মামলায় সাব-রেজিস্ট্রার জাহাঙ্গীর আলমসহ তিনজনের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয়েছে। দুদকের ময়মনসিংহ সমন্বিত জেলা কার্যালয় থেকে মামলাটি করা হয়।
অপর মামলা হয়েছে ২০২১ সালের অক্টোবরে। তখন জাহাঙ্গীর আলম ঢাকার বাড্ডা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে কর্মরত ছিলেন।
মামলায় সাব-রেজিস্ট্রার জাহাঙ্গীর আলম ও তার স্ত্রী রিনা পারভীনের বিরুদ্ধে অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জন এবং সম্পদ বিবরণীতে মিথ্যা তথ্য দাখিলের অভিযোগ আনা হয়েছে। তাদের নামে পৃথকভাবে ৩ কোটি ২৬ লাখ টাকার অধিক মূল্যের জ্ঞাত আয়বহিভূর্ত স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ রয়েছে।

আরও খবর

Back to top button