গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর পূর্ব বিটে দখল বাণিজ্য ধামাচাপার পাঁয়তারা

ঘটনার আড়ালে প্রতিবেদন : গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর রেঞ্জের রাজেন্দ্রপুর পূর্ব বিট এলাকায় মূল্যবান বনভূমি দখল করে বাড়িঘর ও দোকানপাট গড়ে উঠছে। লেনদেন হচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
বিষয়টির ওপর গত ৮ আগস্ট সাপ্তাহিক ঘটনার আড়ালের প্রিন্ট ও ১২ আগস্ট অনলাইন ভার্সনে একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ নিয়ে চলে তোলপাড়।
পরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে রেঞ্জ কর্মকর্তা জুয়েল রানা ঘটনাগুলো সরেজমিনে তদন্ত করেন। কয়েক দিন পর বিট অফিস শুধু একটি স্থাপনায় কিছু ভাঙচুর চালায়। এরপর আর অভিযান চালানো হয়নি।
সরেজমিনে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ইজ্জতপুর এলাকার পুরাতন কবরস্থানের পাশে প্রায় পাঁচ গন্ডা বনভূমি দখল করে বারান্দাসহ পাকা তিন রুমের নতুন বাড়ি নির্মাণ করেছেন ফল ব্যবসায়ী কদম আলী। এই বাড়ি থেকে বিট অফিস প্রথমে ৫০ হাজার টাকা ও শেষে ৩০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছে বলে অভিযোগ।
ইজ্জতপুর রেলক্রসিংয়ের পশ্চিম পাশে কাফিলাতলীতে প্রায় পাঁচ গন্ডা জমি দখল করে রঙিন টিন দিয়ে তিন রুমের বাড়ি নির্মাণ করেছেন সিরাজুল ইসলাম। সিরাজুল প্রথমে কাজ শুরু করলে বিট অফিসের লোকজন গিয়ে ভেঙে দেন। পরে গত জুনের শেষ দিকে আবার কাজ শুরু হয়ে নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়।

বেড়া দিয়ে বন দখল করে সিরাজুলের বাড়ি

সিরাজুলের দখলকৃত জমির মধ্যে কিছু অংশ রেলওয়ের ও বাকিটুকু বনভূমি। সেখানে সুফল প্রকল্পের রোপণকৃত চারাও ছিল। বিট অফিস দুই দফায় ৮০ হাজার টাকা নিয়েছে বলে অভিযোগ।
ইজ্জতপুর স্কুলের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ব্লক ইট তৈরির কারখানা স্থাপন করছেন ঢাকার শাহাদাত হোসেন। তার বৃহৎ প্রজেক্টের তিন পাশে বনভূমি। সেখানে মালবাহী গাড়ি চলাচলের জন্য সাবেক বিট কর্মকর্তা আইয়ুব খানের আমলে ১২০ ফুট দৈর্ঘ্যের রাস্তার কাজ শুরু হয়ে বর্তমান বিট কর্মকর্তার সময়ে শেষ হয়। রাস্তাটি নির্মাণে বনভূমি দখল ও এক লাখ ১০ হাজার টাকা লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ।
ইজ্জতপুর বাজারের পূর্ব পাশে কাফিলাতলী মৌজার আরএস ৩৩ নং দাগের প্রায় ২০ শতাংশ বনভূমি দখল করে চার রুমের মাটির বাড়ি নির্মাণ ও বিভিন্ন গাছপালা রোপণ করেছিলেন সাইদুল ইসলাম। গত ডিসেম্বরে তিনি মামুন নামের একজনের কাছে ১০ লাখ টাকায় সব বিক্রি করে দেন।
পরে মামুন আরসিসি খুঁটি পুঁতে রঙিন টিন দিয়ে বাউন্ডারি ও বারান্দা নির্মাণ করেন। একই সঙ্গে রুমগুলোর ভিটি পাকা করে টাইলস স্থাপন ও রাজকীয় গেট নির্মাণের কাজ শুরু হয়।
এই স্পট থেকে বিট অফিস এক লাখ টাকা নিয়েছে বলে অভিযোগ। বিল্লাল মাস্তান নামের এক দালাল মামুনকে বাড়ি কেনাসহ সার্বিক সহযোগিতা করেন। বাড়ির পূর্ব পাশ থেকে কিছু আকাশমনি, মেহগনি ও গজারি গাছও কেটে বিক্রি করা হয়।
ঘটনার আড়ালে-তে প্রতিবেদন প্রকাশের পর তার বাড়ির টিনের বাউন্ডারি, বারান্দা ও গেটের পিলার ভেঙে দেওয়া হয়। জব্দ করে অফিসে নেওয়া হয় কিছু মালামাল। কিন্তু চারা রোপণসহ অন্যান্য ব্যবস্থা না নেওয়ায় দখল বহাল রয়েছে।
মামুনের বাড়ির দক্ষিণে একই দাগের বনভূমিতে গত মে মাসে তিনটি টিনশেড রুম করে ভিটি পাকা করেছেন জহিরুল ইসলাম। তার কাছ থেকে বিট অফিস এক লাখ টাকা নিয়েছে বলে অভিযোগ।
বাতেন ডাক্তারের বাড়ির পাশে কয়েক মাস আগে প্রায় ১৫ শতাংশ বনভূমি দখল করেছেন সৌদি প্রবাসী খাইরুল বাশার রিপনের স্ত্রী ইয়াসমিন। ওই জমিতে ২০২১ সালে বনায়ন করা হয়েছিল। দখলের কারণে শতাধিক আকাশমনি চারা বিনষ্ট হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রেঞ্জ কর্মকর্তা প্রথমে স্থাপনাগুলো উচ্ছেদের ব্যাপারে তৎপর ছিলেন। পরে বিট কর্মকর্তা এ কে এম ফেরদৌস ও বনপ্রহরী ফিরোজ শেখ নানাভাবে তদবির করেন। এখন ঘটনাগুলো কৌশলে ধামাচাপা দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে।
সূত্র আরও জানায়, ঘটনার আড়ালে-তে প্রতিবেদন প্রকাশের পর কয়েকজন দখলদারের কাছ থেকে ওপরে দেওয়ার কথা বলে আবার টাকা নেওয়া হয়েছে। ফিরোজ শেখ এখন ক্যাশিয়ারের দায়িত্বে আছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুজন জানান, রেঞ্জ কর্মকর্তা দখলদারদের অফিসে ডেকে এনে টাকা লেনদেনের স্বীকারোক্তি নিয়েছেন। এরপরও দায়ীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
শরাফতের দখলের দাপট :
রেঞ্জ অফিসের দক্ষিণ-পূর্ব পাশে আরসিসি খুঁটি পুঁতে টিনের বাউন্ডারি দিয়ে সিএস ১৭৭ নং দাগের সংরক্ষিত বনভূমি দখল করেছেন শরাফত আলী। সেখানে তার পাকা বাড়ির পশ্চিম পাশের বনভূমিতে গত বছর টিনশেড বাড়ি নির্মাণ করে ভাড়া দেওয়া হয়েছে।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি দখল বাণিজ্য নিয়ে অনলাইন সংবাদমাধ্যম আলোকিত নিউজে একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশের পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে অভিযান চালানো হয়। ওই দিন শরাফতের টিনশেড বাড়ির একাংশ, টিনের বাউন্ডারি, কাঠের দোকান, গ্যারেজ, তার খালু নিয়াজ চাঁনের স্যানিটারি ওয়ার্কশপ ও রিয়াজ উদ্দিনের টিনশেড বাড়ির একাংশ উচ্ছেদ করা হয়।
অভিযানের কয়েক দিন পর আবার দখলের তৎপরতা শুরু করেন শরাফত। বিট অফিস তাকে প্রকাশ্যে সহযোগিতা করে। বিষয়টির ওপর গত ৩ এপ্রিল আলোকিত নিউজে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে আবারও অভিযান চালানো হয়।
এবার শরাফতের টিনের বাউন্ডারি কয়েক হাত সরালেও ভেতরে থাকা টিনশেড বাড়ি ও অবশিষ্ট বনভূমি বহাল রাখা হয়। একই সঙ্গে দুই অভিযানে উদ্ধারকৃত আধা বিঘা বনভূমিতে বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ২০০ চারাও রোপণ করে বিট অফিস।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমানে স্থাপনাসহ আনুমানিক পাঁচ শতাংশ বনভূমি শরাফতের দখলে রয়েছে। কোন অভিযানেই দখল কাজে ব্যবহৃত তার টিন ও কাঠ জব্দ করা হয়নি। এমনকি বারবার অপরাধ সংঘটিত হলেও মামলা করেননি বিট কর্মকর্তা।
এদিকে উচ্ছেদ অভিযানের পর ফাওগান রাস্তা সংলগ্ন বনভূমিতে চারা রোপণ না করায় সেখানে ‘বিল্লাল সিএনজি ওয়ার্কশপ’ নামে স্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে। এতে পাশে রোপণকৃত চারাগুলো হুমকির মুখে পড়েছে।
শাহিনের দোকান বহাল :
রাজেন্দ্রপুর বাজার মসজিদের পাশে বনভূমি দখল করে গত ডিসেম্বরে তিনটি পাকা দোকান নির্মাণ করেছেন রিয়াজ উদ্দিনের মেয়ের জামাই শাহিন। দুটি দোকান ভাড়া দেওয়া হয়েছে। একটিতে তিনি মুদি ব্যবসা করছেন।
শাহিন বিট কর্মকর্তা আইয়ুব খানের আমলে টিনশেড থেকে দোকানগুলো পাকা করেন। তাতে তিন লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে বলে প্রচার রয়েছে।
দুবার অভিযান চললেও শাহিনের স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়নি। এসব ঘটনায় বর্তমানে শ্রীপুর রেঞ্জের সাতখামাইর বিটে কর্মরত আইয়ুব খানও রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
অপরদিকে রাজেন্দ্রপুর বাজারের দক্ষিণ অংশে বনভূমি দখল করে দোকান নির্মাণ করেছেন জজ মিয়া। ভাড়া দেওয়া দোকানটি আগে এক চালা ছিল। বর্তমান বিট কর্মকর্তা যোগদানের পর সেটি টিনশেড করে ভিটি পাকা করা হয়েছে।
রেঞ্জ অফিস সংলগ্ন পুকুরের উত্তর-পশ্চিম কোণে বনভূমি দখল করে একটি টিনশেড দোকান করেছেন ডিশ ব্যবসায়ী আরিফ। দ্বিতীয় অভিযানে কয়েকটি টিন অপসারণ করা হলেও কাজ আবার সম্পন্ন হয়েছে।
এ ছাড়া বিট অফিসের দক্ষিণ পাশের খেলার মাঠের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে নতুন ফাউন্ডেশন বাড়ি করেছেন আলী হোসেন। বাড়িটির সামনের অংশে গজারি বন। গেটের সামনে প্রায় এক শতাংশ বন দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে।
ঘটনার আড়ালে-তে প্রতিবেদন প্রকাশের পর দখলকৃত অংশের সামনে কিছু চারা রোপণ করা হয়েছে। তবে লেনদেন থাকায় স্থাপনা উচ্ছেদের সাহস দেখায়নি বিট অফিস।
জানতে চাইলে রেঞ্জ কর্মকর্তা জুয়েল রানা ঘটনার আড়ালে-কে বলেন, কয়েকটি জায়গায় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যেগুলো এখনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, সেগুলো খুব দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কদম আলীর বাড়ির বিষয়ে তিনি বলেন, ওখানে তাদের জমি আছে। তাকে ডিমারকেশনের জন্য আবেদন করতে বলা হয়েছে। ডিমারকেশন ছাড়া কিভাবে কাজ করল? ডিমারকেশন করে ফয়সালা করা হবে।
অথচ নিয়ম অনুযায়ী দাগ পার্ট থাকলে যৌথ ডিমারকেশনের মাধ্যমে সীমানা নির্ধারণ করে কাজ করতে হয়। কিন্তু কদম আলী ডিমারকেশন ছাড়াই কয়েক মাসে বাড়িটি নির্মাণ করে ফেলেন।

আরও পড়ুন : গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর পূর্ব বিটে দখল বাণিজ্য, বন উজাড়

আরও খবর

Back to top button