গাজীপুরের ভবানীপুর বিটে বনভূমি দখলের হিড়িক, বাণিজ্য রমরমা
ঘটনার আড়ালে প্রতিবেদন : গাজীপুরের ভাওয়াল রেঞ্জের চারটি বিটের মধ্যে ভবানীপুর বিট আগে থেকেই দখলপ্রবণ। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর তা ব্যাপক আকার ধারণ করে। ইতিমধ্যে কয়েকটি উচ্ছেদ অভিযান হওয়ার পরও বনভূমি দখল অব্যাহত রয়েছে।
এর নেপথ্য কারণ খুঁজতে গিয়ে বিট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশ থাকার তথ্য মিলেছে। অধিকাংশ দখলে লেনদেন হচ্ছে। গত আড়াই মাসে মোটা অঙ্কের টাকার বাণিজ্য হয়েছে বলে অভিযোগ।
ভবানীপুর বাজারের পশ্চিম পাশে সিএস ১৪২২ নং দাগের ১০ শতাংশ সংরক্ষিত বনভূমি কিনেছেন ঢাকার সিদ্দিকুর রহমান। গত ফেব্রুয়ারিতে সেখানে তিনি ছয় রুমের একটি পাকা মার্কেট নির্মাণ করেছেন। মার্কেটের পশ্চিম পাশে আরও দুটি রুমের কাজ চলছে।
ভবানীপুর বাজারের পশ্চিমে বনভূমিতে নবনির্মিত সিদ্দিকের মার্কেট
সিদ্দিকের মার্কেটের উত্তর পাশে একই দাগের ৭ শতাংশ বনভূমিতে বড় স্থাপনা নির্মাণ করেছেন মিলন। ৫ আগস্টের পর তিনি বাজার এলাকার সাফারি পার্ক রোডের উত্তর পাশে সিএস ১৪১৫ নং দাগের বনভূমিতে একটি মার্কেট নির্মাণ করেন। সেটি এক টিভি-ফ্রিজ ব্যবসায়ীর কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছে।
ভবানীপুর বাজারের পশ্চিমে বনভূমিতে নির্মাণাধীন মিলনের স্থাপনা
মিলনের স্থাপনার উত্তর পাশে বনভূমিতে তার বোন বারান্দাসহ তিন রুমের পাকা বাড়ি নির্মাণ করছেন। এ ছাড়া মিলনের মার্কেটের পাশে ঢাকার সুমন বনভূমি কিনে পৃথক চার রুমের মার্কেট নির্মাণ করেছেন।
ভবানীপুর বাজারের পূর্ব পাশে গুচ্ছগ্রাম রাস্তার দক্ষিণে সিএস ১৩৯৭ নং দাগের ১৫ শতাংশ বনভূমি দখল করে তিন রুমের একটি মার্কেট নির্মাণ করছেন ব্যবসায়ী জালাল। মার্কেটের পেছনে তার একটি গোডাউনের নির্মাণ কাজও চলছে।
ভবানীপুর বাজারের পূর্ব দিকে বনভূমিতে নির্মাণাধীন জালালের মার্কেট ও গোডাউন
ভবানীপুরের মুক্তিযোদ্ধা কলেজের উত্তর পাশে জোতের সঙ্গে ১৪১৫ নং দাগের বনভূমি কিনেছেন ঢাকার আবদুস সাত্তার। ৫ আগস্টের পর সেখানে চার তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে একটি বাড়ি ও গত ফেব্রুয়ারিতে ছয় রুমের স্থাপনা নির্মাণ করে একটি মাদ্রাসার কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। মাদ্রাসার পাশে আরেকটি চার তলা বাড়ির কাজ চলছে। এই জোতের চারপাশে বনভূমি। তার ডিমারকেশন নেই। নির্মাণাধীন বাড়িটির সামনে আরও ১০ শতাংশ বনভূমি দখলে নেওয়া হয়েছে।
ভবানীপুরের কাজী শহীদের পুকুরের উত্তর পাশে সিএস ১০৬৭ নং দাগের বনভূমি কিনে বারান্দাসহ তিন রুমের পাকা বাড়ি নির্মাণ করছেন রফিকুল ইসলামের স্ত্রী কুলসুম। পুকুরের পূর্ব পাশে একই দাগের বনভূমিতে ৫ আগস্টের পর প্রায় অর্ধশত পাকা ও টিনশেড বাড়ি গড়ে উঠেছে।
বানিয়ারচালা এলাকার পাঁচ পীরের মাজারের অল্প উত্তরে রাস্তার পশ্চিম পাশে প্রায় ১৫ শতাংশ বনভূমি কিনেছেন কিশোরগঞ্জের শামীম। কিছুদিন আগে প্লাস্টিকের বস্তা দিয়ে বেড়া দিয়ে একটি টিনশেড বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে।
পাঁচ পীরের মাজারের উত্তরে গোলাপ সাঁইজির কাছ থেকে বনভূমি কিনে নবনির্মিত শামীমের বাড়ি
ভাওয়ালগড় ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি গোলাপ সাঁইজি ওই বনভূমি দখল সূত্রে শামীমের কাছে বিক্রি করেন। বাড়িটিও তিনি দায়িত্ব নিয়ে করে দিয়েছেন। এসবের মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে মোটা অঙ্কের টাকা।
এ ব্যাপারে বিএনপি নেতা গোলাপ সাঁইজির সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি কল ধরেননি।
শামীমের বাড়ির পূর্ব পাশে বনভূমি কিনে টিনশেড বাড়ি নির্মাণ করেছেন রমিজা খাতুন। রমিজার বাড়ির পূর্ব পাশে প্রায় আধা বিঘা বনভূমি দখল করে টিনশেড বাড়ি নির্মাণ করেছেন ইসমাইল হোসেন। বানিয়ারচালা স্কুলের পাশে তার একটি নিজস্ব বাড়ি আছে। ইসমাইলের বাড়ির দক্ষিণে বনভূমিতে প্রায় ২০টি নতুন পাকা ও টিনশেড বাড়ি গড়ে উঠেছে।
রমিজার বাড়ির দক্ষিণ পাশে বাগানের ভেতরে মুরগির ফার্ম করেছেন আবুল কালাম। তিনি আগেও বনভূমি দখল করে আরেকটি মুরগির ফার্ম করেছেন।
কালামের ফার্মের উত্তরে বনভূমিতে ১০টি পাকা ও টিনশেড বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। সাথী, ফাতেমা ও মৃত রমজান আলীর পরিবারসহ অন্যরা গত মাসে স্থাপনাগুলোর কাজ সম্পন্ন করেছেন।
কালামের মুরগির ফার্মের উত্তরে বনভূমিতে নবনির্মিত ১০টি বাড়িঘর
শিরিরচালা এলাকার মালাই অ্যাপারেলসের পশ্চিম পাশে গত ফেব্রুয়ারিতে বনভূমি দখল করে একটি পাকা দোকান নির্মাণ করেছেন তাজউদ্দিন। দোকানের পেছনের অংশে করা হয়েছে চার রুমের টিনশেড বাড়ি।
মালাই কারখানার পূর্ব পাশে ১০ শতাংশ বনভূমি কিনে গত ফেব্রুয়ারিতে একটি দোকান নির্মাণ করেছেন বরিশালের জামাল। দোকানটির পেছনে করা হয়েছে মিনি গার্মেন্টস।
এ ছাড়া মালাই অ্যাপারেলসের পূর্ব দিকে চার রাস্তার মোড়ের পশ্চিম পাশে বনভূমিতে ‘সালাউদ্দিন সুপার মার্কেট’ নামে একটি মার্কেট নির্মাণ করেছেন সালাউদ্দিন আহম্মেদ শান্ত। মার্কেটের পেছনে করা হয়েছে আট রুমের টিনশেড বাড়ি।
মালাই অ্যাপারেলসের পূর্ব দিকে বনভূমিতে নবনির্মিত শান্তর মার্কেট
বানিয়ারচালা এলাকার তেঁতুলতলার উত্তরে রাস্তার পাশে কিছুদিন আগে একটি পাকা দোকান নির্মাণ করেছেন আলী হোসেন। এর আগে সেখানে একটি বাড়ি করা হয়েছে। তার বাড়ির পশ্চিম পাশে বনভূমিতে ইউসুফের দুই রুমের পাকা বাড়ির কাজ চলছে।
মেম্বারবাড়ী বাসস্ট্যান্ডের পূর্ব দিকে কালভার্টের আগে রাস্তার পাশে বনভূমিতে ছয় রুমের পাকা বাড়ির নির্মাণ কাজ চলছে। আমেরিকা প্রবাসী হুমায়ুন বাড়িটি করছেন।
ভৌড়াঘাটা আশ্রয়ণ প্রকল্পের পশ্চিমে আকাশমনি বাগানের পাশে বনভূমি দখল করেছেন আমির হোসেন। সেখানে তিন রুমের পাকা বাড়ির নির্মাণ কাজ গত মাসের শেষ দিকে সম্পন্ন হয়েছে।
ভৌড়াঘাটা আশ্রয়ণ প্রকল্পের পশ্চিমে বনভূমিতে নবনির্মিত আমিরের বাড়ি
ভৌড়াঘাটায় শিল্পপতি কাশেমের প্রজেক্টের পূর্ব পাশে ৭ শতাংশ বনভূমি দখল করে পাকা বাড়ি নির্মাণ করছেন আসমা। তিনি আগেও সেখানে দুটি পাকা রুম করেছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভবানীপুর বিটে আপস দখল বেশ বেড়েছে। ইতিপূর্বে ঘটনার আড়ালে-তে একাধিক সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশের পর উচ্ছেদ অভিযানে কয়েক একর বনভূমি উদ্ধার হয়েছে। কিন্তু এসবের সঙ্গে জড়িত বন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় দৌরাত্ম্য বন্ধ হয়নি। বনাঞ্চল রক্ষায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের জোরালো হস্তক্ষেপ জরুরি।
জানতে চাইলে ভবানীপুর বিট কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন ঘটনার আড়ালে-কে বলেন, বিটের কোথাও নতুন দখল হচ্ছে না। এগুলো আগের। এরপরও তথ্য থাকলে দেখার চেষ্টা করা হবে।