গাজীপুর সদর এসিল্যান্ড অফিসে ঘুষ বাণিজ্য রমরমা
ঘটনার আড়ালে প্রতিবেদন : গাজীপুর সদর উপজেলা ভূমি অফিস ঘুষ-দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দালালদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে সংঘবদ্ধ চক্র।
তারা দীর্ঘদিন ধরে জনসাধারণের কাছ থেকে জমির নামজারি ও জমাভাগ বাবদ লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। কতৃর্পক্ষের নজরদারির অভাবে চক্রটি এখন বেপরোয়া।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গাজীপুর সদর উপজেলা ভূমি অফিসের অধীন তহশিল অফিস সাতটি। অফিসগুলো হল পৌর ভূমি অফিস, সালনা ভূমি অফিস, মির্জাপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিস, বাসন ভূমি অফিস, কোনাবাড়ী ভূমি অফিস, পূবাইল ভূমি অফিস ও বাড়ীয়া ইউনিয়ন ভূমি অফিস।
তহশিল অফিসগুলো থেকে এসিল্যান্ড অফিসে শত শত খারিজের প্রস্তাব পাঠানো হয়। এর মধ্যে মাসে প্রায় এক হাজার নথি অনুমোদন হয়।
এই অনুমোদনপ্রাপ্ত নথিগুলো থেকে সংশ্লিষ্টরা বিভিন্ন হারে ঘুষ আদায় করেন। পরে তা পদ অনুযায়ী ভাগ-বাটোয়ারা হয়।
যেভাবে লেনদেন :
সেবাপ্রার্থী অনলাইনে খারিজের আবেদন করার পর এসিল্যান্ড অফিস থেকে প্রতিবেদনের জন্য সংশ্লিষ্ট তহশিল অফিসে পাঠানো হয়। সেখানে আবেদনে উল্লেখিত মোবাইল নম্বরে ফোন দিয়ে আবেদনকারীকে কাগজপত্র নিয়ে যেতে বলা হয়। আবেদনকারী ভূমি সহকারী কর্মকর্তা বা উপ-সহকারী কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করলে তারা অফিসের কর্মচারী বা উমেদার নামধারী দালাল দেখিয়ে কথা বলতে বলেন।
পরে অফিস খরচের কথা বলে কাজভেদে বিভিন্ন অঙ্কের ঘুষ নেওয়া হয়। এর মধ্যে নির্দিষ্ট একটি অংশ এসিল্যান্ড অফিসে জমা দেওয়া হয়। সেবাপ্রার্থী টাকা না দিলে নানা কারণ দেখিয়ে বিপক্ষে প্রতিবেদন প্রেরণ ও প্রস্তাব নামঞ্জুর করে হয়রানি করা হয়।
ডগরী মৌজায় স্ত্রী রাহেল খাতুন ও তার চার স্বজনের নামে ৪০ শতাংশ জমির খারিজের জন্য মির্জাপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসে যোগাযোগ করেন স্বামী মোফাজ্জল হোসেন। অফিসের ভেতরে নিয়মিত কাজ করা দালাল শফিকুল ১০ হাজার টাকা নিয়ে তাদের আবেদন করে দেন। সেখান থেকে প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য এসিল্যান্ড অফিসে পাঠানো হয়।
কিন্তু শফিকুল এসিল্যান্ড অফিসের খরচ না দেওয়ায় হালসন ওয়ারিশান সনদ না থাকার কথা উল্লেখ করে প্রস্তাব বাতিল করা হয়। অথচ এসিল্যান্ড অফিস থেকে আবেদনকারীকে কিছুই জানানো হয়নি।
পরে খবর পেয়ে আবারও অনলাইনে আবেদন করা হয়। এবার শফিকুল লেনদেন ঠিক রাখায় খারিজ দ্রুত অনুমোদন হয়। নথি নম্বর ১১৩৫০/২০২২-২৩।
আবেদনকারীর এক স্বজন খারিজের কপির জন্য এসিল্যান্ড অফিসে গেলে অফিস সহকারী দীপঙ্কর চন্দ্র দাস একজনকে ডেকে ফাইল কার নামে ও টাকা জমা হয়েছে কি না দেখতে বলেন। পরে ওই ব্যক্তি দালাল শফিকুলের নাম ও টাকা জমা হওয়ার কথা জানালে তাকে খারিজের কপি দেওয়া হয়।
এসিল্যান্ড অফিসের রেট :
গাজীপুর সদর উপজেলা ভূমি অফিসে আগে সাধারণ খারিজে ঘুষের রেট ছিল নথিপ্রতি ১৬০০ টাকা। বর্তমান সহকারী কমিশনার (ভূমি) রাফে মোহাম্মদ ছড়া যোগদানের পর গত বছর তা এক লাফে বেড়ে ৩৫০০ টাকা হয়। এ নিয়ে খোদ ভূমি অফিসের অনেকেও ক্ষুব্ধ।
এ ছাড়া অবমুক্ত হওয়া অর্পিত সম্পত্তির ‘খ’ তফসিলভুক্ত জমির খারিজে এসিল্যান্ড অফিসে নয় হাজার টাকা করে দিতে হয়। জমির পরিমাণ বেশি হলে বা কাগজপত্রে কোন ত্রুটি থাকলে ৫০ হাজার টাকা থেকে কয়েক লাখ টাকা লেনদেন হয়। এসব এখন ওপেন সিক্রেট।
প্রতি মাসে অনুমোদনপ্রাপ্ত প্রায় এক হাজার নথির মধ্যে বিশেষ কিছু বাদে বাকিগুলো থেকে ঘুষ নেওয়া হয়। সাধারণ খারিজের ন্যূনতম ৩৫০০ টাকা করে হিসাব ধরলেও নথিগুলো থেকে মাসে আদায়কৃত ঘুষের পরিমাণ দাঁড়ায় অন্তত ৩০ লাখ টাকা।
সার্ভেয়ার যখন ক্যাশিয়ার :
গাজীপুর সদর উপজেলা ভূমি অফিসে ঘুষের টাকার ক্যাশিয়ারের দায়িত্বে আছেন সার্ভেয়ার আবদুল আলীম। অফিসের ভেতরে কাজ করা একাধিক উমেদারের মাধ্যমে তার কাছে টাকা জমা হয়। তিনি আগে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কার্যালয়ের এসএ শাখায় ছিলেন।
কয়েকটি অফিসের বেশ কয়েকজন দালালের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভূমি অফিসগুলোতে যত খারিজ হয়, তার বেশির ভাগই উমেদারদের মাধ্যমে হয়। বাকিগুলোর মধ্যে কিছু করেন অফিসের কর্মচারীরা আর কিছু করেন ব্যক্তি নিজে। এসিল্যান্ড অফিসের রেট বেশি থাকায় লোকজনের কাছ থেকে টাকা বেশি নিতে হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্র জানায়, প্রতিটি আবেদনে আবেদনকারী বা তার নিকটজনের মোবাইল নম্বর উল্লেখ থাকে। কতৃর্পক্ষ এই সূত্র ধরে তদন্ত করলেই কোন খারিজ কার মাধ্যমে হচ্ছে ও কী পরিমাণ টাকা নেওয়া হচ্ছে-বিস্তারিত বেরিয়ে আসবে। হয়তো কিছু লোক ভয়ে কিছু বলতে চাইবেন না, তবে অনেকে সত্য বলে দিবেন।
নাজিরের ডিসিআর বাণিজ্য :
গাজীপুর সদর উপজেলা ভূমি অফিসে নাজির পদে আছে সুমন মিয়া। তিনি টানা তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে বহাল থেকে ডিসিআর বাণিজ্য করছেন। যদিও ভূমি মন্ত্রণালয় অফিসে কোন ধরনের ডিসিআর না কাটার জন্য একাধিকবার নির্দেশনা জারি করেছে।
এসিল্যান্ড অফিসে খারিজ অনুমোদন হওয়ার পর ১১০০ টাকা সরকারি ফি দিয়ে অনলাইনে ডিসিআর কাটতে হয়। নাজির সুমন মিয়া নিজে ডিসিআর কাটেন। তিনি ১১০০ টাকার ডিসিআরে কালার প্রিন্টের নামে ১৩০০ টাকা করে আদায় করেন। অর্থাৎ প্রতি ডিসিআরে ২০০ টাকা বেশি নেওয়া হয়। ডিসিআরের কপিতে জলছাপে ‘গাজীপুর সদর উপজেলা ভূমি অফিস’ লেখা উল্লেখ থাকে।
নাজির সুমন মিয়া এভাবে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অমান্য করে মাসে প্রায় ৪০০ খারিজের ডিসিআর কাটেন। যাতে বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়ায় পৌনে এক লাখ টাকা।
কয়েকজন সেবাপ্রার্থী জানান, তারা নাজিরের কাছ থেকে ডিসিআর কাটার পর জানতে পারেন যে বাইরের কম্পিউটারের দোকানে মাত্র ৫০-১০০ টাকা লাগে। অফিসে ঘুষ ছাড়া ফাইল নড়ে না।
এ ব্যাপারে অফিসে গিয়ে নাজির সুমন মিয়াকে পাওয়া যায়নি। তার সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি কল ধরেননি।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) রাফে মোহাম্মদ ছড়া অফিসে ডিসিআর কাটার সত্যতা স্বীকার করে ঘটনার আড়ালে-কে বলেন, ডিসিআরে ১৩০০ টাকা নেওয়ার তো কথা না। আপনি আমার কাছে কয়েকজন লোক নিয়ে আসেন। আমার জানামতে এ রকম কিছু হয় না।
খারিজে ৩৫০০ টাকা করে নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ রকম তো হওয়ার কথা না। কে ৩৫০০ টাকা নিয়েছে, আমার কাছে লোক নিয়ে আসেন।