গাজীপুরের মনিপুর বিটে গাছ কেটে বন উজাড়, ‘আপস দখল’ জমজমাট
ঘটনার আড়ালে প্রতিবেদন : গাজীপুরের ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক সংলগ্ন হোতাপাড়া এলাকা থেকে আড়াই কিলোমিটার পশ্চিমে মনিপুর বাজার। শিল্প প্রতিষ্ঠান অধ্যুষিত এলাকাটিতে নানা ব্যবসা-বাণিজ্য জমজমাট।
সেখানে দীর্ঘদিন ধরে সংরক্ষিত বন উজাড় ও বনভূমি বেহাত হচ্ছে। গড়ে উঠছে বাড়িঘর ও দোকানপাট। বন কর্মকর্তারা শুরুতে দখল প্রতিরোধে জোরালো ভূমিকা না নেওয়ায় জটিলতা বাড়ছে।
গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর সৃষ্ট অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সুযোগে বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক বনভূমি দখল শুরু হয়। ঢাকা বন বিভাগের রাজেন্দ্রপুর রেঞ্জের মনিপুর বিটেও তা মারাত্মক আকার ধারণ করে।
বিট অফিসের লোকজন প্রথম দিকে বাধা দিতে গিয়ে আক্রমণাত্মক পরিস্থিতির মুখে পড়েন। পরে মামলার ভয়ে সেপ্টেম্বর থেকে আপস দখল শুরু হয়। গত মাসে একটি দখল প্রতিরোধে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা পাওয়ার পর অন্য দখলকারীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। দুই মাস ধরে বেশির ভাগ দখলে লেনদেন হচ্ছে।
মনিপুর খাসপাড়ায় আকাশমনি বাগানের গাছ কেটে নতুন চারটি টিনশেড দোকান নির্মাণ করেছেন ড্রাইভার আলাল ও কসাই শাহজাহান। মনিপুর-পিরুজালী সড়কের দক্ষিণ পাশে গত মাসে প্রকাশ্যে এ দখল সম্পন্ন হয়েছে।
মনিপুর বাজারের দক্ষিণ পাশে মসজিদ রোডে বনভূমি দখল করে চারটি দোকান নির্মাণ করেছেন নূর ইসলাম। দোকানগুলো ইতিমধ্যে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। নূর ইসলামের দোকানের পাশে বনভূমিতে দুটি দোকান তুলে ওষুধের ব্যবসা করছেন হরলাল দেবনাথ। তার ফার্মেসির পশ্চিম পাশে বনভূমিতে আরেকটি দোকান তুলেছেন ইসমাইল।
মনিপুর বাজারের পূর্ব পাশে বর্মন ভিলা। ভিলার পাশে বনভূমিতে তিন ভাই মনু বর্মন, নারায়ণ বর্মন ও মিলন বর্মন চার রুম করে পৃথক তিনটি টিনশেড বাড়ি নির্মাণ করেছেন।
মনিপুর নামাপাড়া এলাকায় গত মাসে বনভূমি দখল করে নতুন চারটি টিনশেড রুম নির্মাণ করেছেন মিলন। তার বাড়ির পাশে বনভূমিতে ছয়টি রুম করেছেন নূরুল ইসলাম। নূরুল ইসলামের বাড়ির আশপাশে বনভূমিতে চারটি টিনশেড রুম করেছেন মোখলেস, চারটি রুম করেছেন মিজান, চারটি রুম করেছেন পারভেজ ও তিনটি রুম করেছেন আবদুস সাত্তার।
বেগমপুর হোতাপাড়া এলাকার আবদুর রহমানের বাড়ির পশ্চিম পাশে মিঞ্জুরি বাগান। ৫ আগস্টের আগে-পরে প্রায় অর্ধশত বড় বড় গাছ কেটে বাগান উজাড় করেছেন স্থানীয় নূর ইসলাম। পরে সেখানে তিনি ছেলে ইকবালের জন্য একটি বাড়ি নির্মাণ করেন। তার কাছ থেকে জোসনা ও রেকসনাসহ ছয়জন প্লট আকারে বনভূমি কিনে নতুন ছয়টি টিনশেড বাড়ি করেছেন।
বেগমপুরে মিঞ্জুরি বাগানের গাছ কেটে নবনির্মিত বাড়িঘর
বেগমপুরে বাবুল মেম্বারের গোডাউনের পাশে নোয়াখালীর রোকেয়া আক্তার আকাশমনি বাগানের কিছু চারা বিনষ্ট করে পাঁচ রুমের টিনশেড মার্কেট নির্মাণ করছেন। মার্কেটটির কাজ চলছে দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে। জেসন এগ্রোভেট কারখানার একটু পূর্ব পাশে আকাশমনি বাগানের প্রায় ২০টি চারা বিনষ্ট করে বারান্দাসহ তিন রুমের বাড়ি করেছেন আবদুল হামিদ।
নয়াপাড়া এলাকার আজমল হকের কাছ থেকে পাঁচ শতাংশ বনভূমি কিনে বারান্দাসহ দুই রুমের বাড়ি নির্মাণ করেছেন বিল্লাল। তার বাড়ির পূর্ব পাশে বনভূমিতে আরেকটি বাড়ির কাজ চলছে।
নয়াপাড়ার কাজল মার্কেটের পাশে বনভূমিতে নবনির্মিত শাহীনের বাড়ি
নয়াপাড়ার কাজল মার্কেটের দক্ষিণ পাশে পাঁচ শতাংশ বনভূমি কিনে বারান্দাসহ তিন রুমের নতুন একটি বাড়ি নির্মাণ করেছেন শাহীন। তার বাড়ির দক্ষিণ পাশে বনভূমিতে দুটি বাড়ি করে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। কাজল মার্কেটের পশ্চিম পাশে বনভূমিতে বারান্দাসহ দুই রুমের বাড়ি ও একটি দোকান করেছেন কাইয়ুম। দোকানটি ভাড়া দেওয়া হয়েছে। তার বাড়ির দক্ষিণ পাশে বনভূমিতে সাম্প্রতিক সময়ে টিনশেড বাড়ি করা হয়েছে প্রায় ২০টি।
কাজল মার্কেটের পাশে বনভূমিতে নবনির্মিত দোকানসহ কাইয়ুমের বাড়ি
নয়াপাড়ার কেমিকন কারখানার মালিক মো. ইয়ামিন তাদের পূর্ব পাশের বাউন্ডারি ওয়াল সংলগ্ন পাঁচ শতাংশ বনভূমি কিনে ১০ ফুট উঁচু বাউন্ডারি ওয়াল ও ভেতরে তরল বর্জ্য জমা রাখার জন্য গভীর হাউজ নির্মাণ করছেন। দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে তাদের কাজ চলছে।
এলাকাগুলোতে এ ধরনের নবনির্মিত অসংখ্য স্থাপনা রয়েছে। বিট অফিস সাধারণ স্থাপনা বাবদ ২০ হাজার টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকা করে নিচ্ছে বলে অভিযোগ। আর বড় স্থাপনায় লেনদেন হচ্ছে এক-দেড় লাখ টাকা।
বিট অফিস সূত্র জানায়, বর্তমান বিট কর্মকর্তা ওয়ালিদ বিন মতিন অত্যন্ত কৌশলী প্রকৃতির। তিনি একাধিক বনকর্মী ও দালালের মাধ্যমে বনভূমি দখলকারীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। যারা বিট অফিসের অনুমতি ছাড়া স্থাপনা নির্মাণ করেছেন, এখন তাদের তালিকা করে মামলার ভয় দেখিয়ে টাকা নেওয়া হচ্ছে।
এ ছাড়া বিট কর্মকর্তা বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দখলকারীদের বলছেন যে সাংবাদিকরা ছবি তুলে নিউজ করছে, আপনারা সতর্ক থাকবেন। নিউজ না হলে আমরা সব ভাঙব না, সবার বিরুদ্ধে মামলাও দিব না।
সম্প্রতি বিট কর্মকর্তা মনিপুর নামাপাড়ার কিছু লোক নিয়ে বিট অফিসের ভেতরে একটি বৈঠক করেছেন। এতে দখলকারীরা বিট কর্মকর্তার উসকানি পেয়ে বনভূমি দখল নিয়ে প্রতিবেদন করেন, এমন সাংবাদিকদের ওপর ক্ষিপ্ত হচ্ছেন।
বিট কর্মকর্তা ওয়ালিদ বিন মতিন লেনদেনের অভিযোগ অস্বীকার করে ঘটনার আড়ালে-কে বলেছেন, তিনি স্টাফদের নিয়ে দখল প্রতিরোধের চেষ্টা করছেন। ডিএফও বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা শুধু চাপ দেন, কেউ মাঠে এসে সহযোগিতা করেন না।
অপরদিকে মনিপুর খাসপাড়া এলাকার কবরস্থানের পশ্চিম পাশে প্লট আকারে ছয় শতাংশ বনভূমি বিক্রি করেছেন স্থানীয় আলাউদ্দিন। এলিগেন্স পোশাক কারখানার কর্মকর্তা সাইদুর রহমান চার লাখ ৬০ হাজার টাকায় একটি প্লট কিনে বাড়ি নির্মাণ করেছেন।
আকাশমনি বাগানের কয়েকটি গাছ কেটে টিনশেড বাড়ি নির্মাণ করে অপর প্লট হোটেল ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলীর কাছে পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। কাজ শুরুর সময় রেঞ্জ কর্মকর্তা জুয়েল রানা খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে বাধা দিলেও শেষে বিট অফিসের সহযোগিতায় কাজ সম্পন্ন হয়।
বিষয়টি গত ৪ জুন ঘটনার আড়ালের প্রতিবেদনে তুলে ধরা হলে রেঞ্জ কর্মকর্তা দখলকারীদের নিজ দায়িত্বে স্থাপনা সরিয়ে নিতে দুই দিন সময় বেঁধে দেন। কিন্তু দুই দিনের স্থলে পাঁচ মাস অতিবাহিত হলেও তিনি রহস্যজনক কারণে অভিযান চালাননি।