গাজীপুরে তহশিলদার মাহ্ আলমের বেপরোয়া ঘুষ বাণিজ্য, বনের জমি খারিজ!

ঘটনার আড়ালে প্রতিবেদন : গাজীপুরের সালনা ভূমি অফিসে ঘুষ-দুর্নীতি ঝেঁকে বসেছে। টাকা ছাড়া মিলছে না সেবা। ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়েছেন জনসাধারণ।
ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মাহ্ আলম অফিসটিতে প্রায় আড়াই বছর ধরে নীরবে বাণিজ্য করছেন। কর্তৃপক্ষের যথাযথ তদারকি না থাকায় তিনি কাউকে পরোয়া করছেন না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মাহ্ আলম অত্যন্ত কৌশলী ও ধূর্ত প্রকৃতির। সব সময় লোভনীয় ভূমি অফিসে পোস্টিং বাগিয়ে নেন। তিনি সদর উপজেলা ভূমি অফিসের অধীন সালনা ইউনিয়ন ভূমি অফিসে ২০২১ সালের ১ জুন যোগদান করে বেপরোয়া বাণিজ্যে মেতে উঠেছেন।
ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মাহ্ আলম জমির নামজারি, মিসকেসের প্রতিবেদন, ডিমারকেশনের প্রতিবেদন-সব কাজেই বিভিন্ন হারে ঘুষ আদায় করেন। টাকা না দিলে তিনি নানা কারণ দেখিয়ে সেবাপ্রার্থীকে হয়রানি করেন।
সালনা ভূমি অফিস থেকে মাসে প্রায় ২০০ খারিজের প্রস্তাব এসিল্যান্ড অফিসে পাঠানো হয়। বিশেষ কিছু বাদে বাকিগুলো থেকে তিনি ঘুষ নেন। সাধারণ খারিজে ঘুষের রেট সাড়ে তিন হাজার টাকা, জমির পরিমাণ বেশি হলে ৫-১০ হাজার টাকা এবং কাগজপত্রে ত্রুটি থাকলে ২০-৫০ হাজার টাকা থেকে লাখ টাকাও লেনদেন হয়।
কয়েকজন সেবাপ্রার্থী জানান, অন্যান্য অফিসের মত সালনা ভূমি অফিসেও ঘুষ ওপেন সিক্রেট। নায়েব মাহ্ আলম বড় কাজের চুক্তি নিজে করেন। আর সাধারণগুলোর টাকা কর্মচারী বা দালালদের মাধ্যমে নেওয়া হয়।
টেক কাথোরা মৌজায় ৬৭ শতাংশ জমির খারিজের জন্য আবেদন করেন অশোক কুমার বৈদ্য। নথি নম্বর ৩৩০৯৩/২০২২-২৩। ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মাহ্ আলম ‘অনলাইন আবেদনে রেকর্ডীয় মালিকের ঘরে দলিল দাতার নাম উল্লেখ করা হয়েছে’ মর্মে ভুল ধরে আবেদন বাতিলের সুপারিশ করে বিপক্ষে প্রতিবেদন দেন। পরে সহকারী কমিশনার (ভূমি) রাফে মোহাম্মদ ছড়া আবেদন সরাসরি বাতিল করে দেন।
অশোক কুমার আবারও অনলাইনে আবেদন করেন। নথি নম্বর ৩৪৭৬০। এবার ‘জোতে আবেদনের সমপরিমাণ জমি নেই’ উল্লেখ করে বিপক্ষে প্রতিবেদন যাওয়ায় আবেদন বাতিল হয়।
এরপর অফিসের পরামর্শে তিনি একই তফসিলের আবেদন তৃতীয়বার করেন। নথি নম্বর ৩২৮৩। এবার মাহ্ আলমের চাহিদা পূরণ করায় পক্ষে প্রতিবেদন জমা হয়ে প্রস্তাব অনুমোদন হয়।
উত্তর সালনা মৌজায় পাঁচ শতাংশ ৬০ পয়েন্ট জমির খারিজের জন্য আবেদন করে রফিকুল ইসলাম গং। নথি নম্বর ৩৩৫৭৮/২০২২-২৩। মাহ্ আলম ‘আরএস রেকর্ডে জোতে জমি নেই’ উল্লেখ করে বিপক্ষে প্রতিবেদন দেওয়ায় আবেদন বাতিল হয়।
পরে তিনি একই আবেদন দ্বিতীয়বার করেন। নথি নম্বর ৮২১০। এবার বাধ্য হয়ে মাহ্ আলমের চাহিদা পূরণ করায় পক্ষে প্রতিবেদন জমা হয়ে প্রস্তাব অনুমোদন হয়।
জোলারপাড় মৌজায় আবদুল কুদ্দুস ৬১ শতাংশ ১৩ পয়েন্ট জমির খারিজের জন্য আবেদন করেন। নথি নম্বর ১৭১৫/২০২২-২৩। মাহ্ আলম ‘আবেদনের চেয়ে জমি কম’ উল্লেখ করে বিপক্ষে প্রতিবেদন দেওয়ায় আবেদন বাতিল হয়।
পরে তিনি একই আবেদন দ্বিতীয়বার করেন। নথি নম্বর ৩৭১৮। এবার মাহ্ আলমের চাহিদা পূরণ করায় পক্ষে প্রতিবেদন জমা হয়ে প্রস্তাব অনুমোদন হয়।
টেক কাথোরা মৌজায় ৯৬ শতাংশ জমির খারিজের জন্য আবেদন করে রুপবান বিবি গং। নথি নম্বর ২০৭৫১/২০২২-২৩। মাহ্ আলম ‘এসএ ও আরএস রেকর্ডে মিল নেই’ উল্লেখ করে বিপক্ষে প্রতিবেদন দেওয়ায় আবেদন বাতিল হয়।
পরে তিনি দ্বিতীয়বার আবেদন করেন। নথি নম্বর ৩১৯২৩। এবারও মাহ্ আলমের চাহিদা পূরণ না করায় ‘প্রাপ্যতার অতিরিক্ত জমির আবেদন করা হয়েছে’ উল্লেখ করে বিপক্ষে প্রতিবেদন দেন। তিনি একই তফসিলের আবেদনে দুই ধরনের প্রতিবেদন দিয়ে সেবাপ্রার্থীদের হয়রানি করছেন।
অথচ ভূমি মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত পরিপত্রে স্পষ্টভাবে নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়েছে, কোন তথ্যের ঘাটতি থাকলেই নামজারি আবেদন বাতিল করা যাবে না। প্রথম আদেশে দলিলপত্রের ঘাটতি থাকলে যুক্তিসংগত সময় দিতে হবে। আবেদনকারী তথ্য বা কাগজপত্র দাখিলে ব্যর্থ হলে দ্বিতীয় আদেশে নামঞ্জুর করা যাবে। পরবর্তীকালে চাহিত তথ্য প্রাপ্তি সাপেক্ষে পুনরায় কার্যক্রম চালু করতে হবে।
কিন্তু মাহ্ আলম টাকা না পেলেই মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অমান্য করে দেদারসে খারিজের আবেদন বাতিলের সুপারিশ পাঠাচ্ছেন। আর এসিল্যান্ড রাফে মোহাম্মদ ছড়াও আবেদনগুলো বাতিল করে জনসাধারণের ভোগান্তি বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
বনের জমি ব্যক্তি নামে খারিজ :
ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মাহ্ আলম ১৯৯৮-৯৯ সালে সালনা ভূমি অফিসে ভূমি উপ-সহকারী কর্মকর্তা ছিলেন। তখন গাজীপুর মৌজার শাহজাহান সিকদার বন বিভাগের নামে গেজেটভুক্ত সিএস ৩ নং দাগের সাড়ে ২৬ শতাংশ বনভূমি ব্যক্তি নামে খারিজ করেন। যার নথি নম্বর ৭১৭৬ ও জোত নম্বর ৩১৭।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মাহ্ আলমের সঙ্গে চুক্তি করে শাহজাহান সিকদার খারিজের আবেদন করেন। পরে মাহ্ আলম প্রকৃত তথ্য গোপন করে পক্ষে প্রতিবেদন দিলে প্রস্তাব অনুমোদন হয়। খারিজ অনুমোদনের পর খাজনার রসিদও মাহ্ আলম নিজ হাতে কেটে দেন।
কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, খারিজে বর্ণিত সিএস ৩ নং দাগ পার্ট নয়, পুরো গেজেটভুক্ত। শুধু ৪৬৭ নং বাটা দাগের বন্দোবস্তকৃত এক একর ৪০ শতাংশ জমি গেজেট বহিভূর্ত। খারিজে গেজেটভুক্ত সিএসের সঙ্গে আরএস ৭৫ নং দাগ উল্লেখ রয়েছে। আরএস রেকর্ডে একাধিক দাগ ব্যক্তি নামে উঠলেও রেকর্ড সংশোধনীর মামলা করেনি রাজেন্দ্রপুর রেঞ্জের সালনা বিট অফিস।
একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকারি সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণে সিএস রেকর্ডকে ভিত্তি ধরে কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সিএস রেকর্ডে পার্ট না থাকলে দাগের পুরো জমির মালিক বন বিভাগ। গেজেটের তথ্য গোপন করে খারিজ দেওয়া গুরুতর অপরাধ। তর্কিত খারিজ বাতিলসহ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, আরএস রেকর্ড সংশোধনী নিয়ে বন বিভাগের পক্ষে গাজীপুর দেওয়ানি আদালতে অনেক মামলা চলমান রয়েছে। পক্ষে রায়ও হচ্ছে। ওই দাগের মূল্যবান বনভূমি রক্ষায় বন কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
মাহ্ আলম যেভাবে কোটিপতি :
ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মাহ্ আলমের পৈতৃক বাড়ি জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার মধ্যপাড়া ইউনিয়নের ঠেঙ্গারবান্দ গ্রামে। তার বাবা ছিলেন সাধারণ কৃষক। টানাপোড়েনের সংসারে মাহ্ আলম অন্যের বাড়িতে লজিং থেকে পড়ালেখা করেন।
ভূমি প্রশাসনে চাকরি হওয়ার পর ধীরে ধীরে আর্থিক পরিবর্তন শুরু হয়। যে বেতন-ভাতায় সংসার ও পরিবার নিয়ে সাধারণভাবে চলার কথা, সেখানে স্বপ্ন দেখেন বিলাসিতার। এক পর্যায়ে তা বাস্তব রূপ লাভ করে।
মাহ্ আলম ২০১৮ সাল থেকে ২০২১ পর্যন্ত তিন বছর তিন মাস পৌর ভূমি অফিসে কর্মরত ছিলেন। তখন তিনি অন্যান্য অফিসের মত এই অফিসেও ভদ্রতার লেবাসে হাজার হাজার নথি থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন। মহানগরীর প্রাণকেন্দ্রে কিনেন একাধিক ফ্ল্যাট।
রেলক্রসিং এলাকার কলাপট্টির উত্তরে হাজীপাড়া এলাকায় আট তলা জেসমিন ভিলা। হোল্ডিং নম্বর জি-২৬/১। ভবনটির নিচে মনিদীপ চক্ষু হাসপাতাল। এই ভবনের অষ্টম তলায় একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন মাহ্ আলম।

হাজীপাড়ার জেসমিন ভিলায় স্ত্রীর নামে ফ্ল্যাট


তিনি ১১০০ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাটটি ৩৫-৪০ লাখ টাকা দিয়ে তার স্ত্রীর নামে কিনেছেন। তার স্ত্রী একজন গৃহিণী। একই তলায় তার সম্বন্ধীর নামেও একটি ফ্ল্যাট রয়েছে।
মাহ্ আলম রাজবাড়ি রোডের অভিজাত প্রকৌশলী ভবনে আরেকটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। মোটা অঙ্কের টাকায় কেনা ওই ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া।
তিনি এর আগে হাজীপাড়ার উত্তরে সাহাপাড়া এলাকায় এক আমেরিকা প্রবাসীর কাছ থেকে একটি প্লট কিনেছেন। প্লটটি সাহাপাড়া মসজিদের উত্তর দিকে আলী ভিলা সংলগ্ন দক্ষিণ পাশে অবস্থিত। বাউন্ডারি ওয়ালবেষ্টিত ওই প্লটের আয়তন পৌনে তিন কাঠা।

সাহাপাড়ায় নিজ নামে প্লট


এ ছাড়া মাহ্ আলম গ্রামের বাড়ির এলাকায়ও কয়েক বিঘা জমি কিনেছেন। নামে-বেনামে কেনা এসব সম্পদের বাইরে তার আরও কয়েক কোটি টাকার অর্থ-সম্পদ রয়েছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
উমেদার সমাচার :
সালনা ভূমি অফিসের ভেতরে দীর্ঘদিন ধরে বেশ কয়েকজন উমেদার নামধারী দালাল সরকারি কর্মচারীর মত বিভিন্ন কাজ করে আসছিলেন। তাদের মধ্যে কাপাসিয়ার আলম, বেলায়েত, লুৎফর, রেজাউল, সোহরাব ও রওশন আরা আলোচিত।
বিষয়টির ওপর গত ৪ সেপ্টেম্বর সাপ্তাহিক ঘটনার আড়ালে-তে ‘গাজীপুরের সালনা ভূমি অফিসে ব্যাপক ঘুষ বাণিজ্য, দালালরা হর্তাকর্তা, সেবাপ্রার্থীদের ভোগান্তি’ শিরোনামে একটি তথ্যবহুল প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ নিয়ে চলে ব্যাপক তোলপাড়। ওই দিনই উমেদারদের অফিস থেকে বের করে দেওয়া হয়।
তবে দালালরা এখন বাইরে অবস্থান করে জনসাধারণের কাছ থেকে খারিজ ও মূল জোতের খাজনা কম দেওয়ার চুক্তি করে টাকা নেন। তারা ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মাহ্ আলমের নির্দেশনায় অফিসে ঢুকে অল্প সময় থেকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে চলে যান। ‘ছোট নায়েব’ খ্যাত দালাল আলম এখনো মাহ্ আলমের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন।
এ ব্যাপারে ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মাহ্ আলম ঘটনার আড়ালের কাছে দাবি করেন, তিনি খারিজে কারও কাছ থেকে টাকা নেন না। দালাল আলম ১৫ বছর আগে থেকে অফিসে কাজ করছিলেন। এখন তাকে ঢুকতে দেওয়া হয় না।
সম্পদের বিষয়ে মাহ্ আলম বলেন, জেসমিন ভিলার ফ্ল্যাট কিস্তিতে কেনা হয়েছে। সাহাপাড়ার প্লট তিনি ২০১০ সালে পৈতৃক জমি বিক্রি করে কিনেছেন। প্রকৌশলী ভবনে তার ফ্ল্যাট নেই। দুদকও অভিযোগ পেয়ে তদন্ত করে অবৈধ কিছু পায়নি।
বনের জমি খারিজ প্রসঙ্গে মাহ্ আলম বলেন, ওই জমি বনের নয়, ব্যক্তি নামে রেকর্ড। খারিজ তিনি দেননি, তৎকালীন তহশিলদার দিয়েছেন। জেলা প্রশাসকের কাছে একজন অভিযোগ করেছিলেন, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তদন্ত করে কিছু পাননি।

আরও পড়ুন : গাজীপুরের সালনা ভূমি অফিসে ব্যাপক ঘুষ বাণিজ্য, দালালরা হর্তাকর্তা!

আরও খবর

Back to top button