জয়দেবপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘আওয়ামী দাপটে’ প্রধান শিক্ষক লতার বেপরোয়া দুর্নীতি!
ঘটনার আড়ালে প্রতিবেদন : জয়দেবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গাজীপুর শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম মডেল হিসেবে উপস্থাপনের উদ্দেশে প্রাক-প্রাথমিক থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদানের বিশেষ উদ্যোগ নেয় শিক্ষা অধিদপ্তর।
কিন্তু বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক বদরুন নেছা লতার বেপরোয়া দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে সেসব উদ্দেশ্য ভেস্তে যাচ্ছে। অভিভাবকদের মধ্যে বিরাজ করছে চাপা ক্ষোভ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গাজীপুর সরকারি মহিলা কলেজ সংলগ্ন জয়দেবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুটি শিফটে বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৭০০। বিদ্যালয়টিতে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের ছাত্র-ছাত্রী বেশি। তাদের কাছ থেকে দীর্ঘদিন ধরে বিধি বহির্ভূতভাবে বিভিন্ন ফির নামে লাখ লাখ টাকা আদায় করে আত্মসাৎ করা হচ্ছে।
এর মধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সেশন ফি বাবদ ১০০০ টাকা, ক্লাস পার্টির নামে ২৫০-৩০০ টাকা, স্কুল ড্রেসের মনোগ্রাম বাবদ ২০০ টাকা, পরীক্ষার খাতা বাবদ ১০০ টাকা, খাতা পরীক্ষার্থী নিজে আনলে ৬০ টাকা, পরীক্ষার সাজেশন শিট বাবদ ২০ টাকা, দ্বিতীয় পার্বিক পরীক্ষার মার্কশিট বাবদ ৩০ টাকা, বার্ষিক পরীক্ষার মার্কশিট বাবদ ২০০ টাকা ও কাজের বুয়ার ফি বাবদ ৬০ টাকা করে নেওয়া হয়।
অথচ সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এভাবে ফি আদায়ের কোন নিয়ম নেই। আদায়কৃত টাকা সরকারের কোষাগারেও জমা হয় না। প্রধান শিক্ষক বদরুন নেছা লতা একাই বড় অংশ হাতিয়ে নিচ্ছেন।
সরকার সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণের জন্য যেখানে উপবৃত্তিসহ নানা সুবিধা দিচ্ছে, সেখানে একশ্রেণির অসাধু শিক্ষকের জন্য অযৌক্তিক ব্যয় বাড়ছে। অভিভাবকরা বাধ্য হয়ে সেসব নীরবে সয়ে যাচ্ছেন।
অভিযুক্ত বদরুন নেছা লতার পৈতৃক বাড়ি নগরীর কাথোরা গ্রামে। তিনি প্রথমে জয়দেবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। পরে পদোন্নতি পেয়ে পূবাইলের বারইবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হন। সেখান থেকে ২০০৭ সালে বদলি হয়ে জয়দেবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন।
এরপর চলে গেছে প্রায় দেড় যুগ। শিক্ষা প্রশাসন বদরুন নেছা লতাকে আর কোথাও বদলি করেনি। দীর্ঘ সময় একই কর্মস্থলে থাকায় বিদ্যালয়টিতে তার একক আধিপত্য চলছে। খুঁটি পোক্ত করতে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতেও জড়িয়ে পড়েন। নেতাদের সঙ্গে গড়ে তুলেন সখ্যতা।
সেই সখ্যতার পুরস্কারও পেয়েছেন বদরুন নেছা লতা। একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান হয়েও দায়িত্ব পালন করেছেন দুটি প্রতিষ্ঠানে। তিনি ২০২২ সাল থেকে চলতি বছরের ৩০ জুলাই পর্যন্ত দুই বছর জেলা জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান ছিলেন।
অভিযোগ রয়েছে, বদরুন নেছা লতার ওপর সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকসহ একাধিক শীর্ষ নেতার বিশেষ আশীর্বাদ রয়েছে। রাজনৈতিক সুপারিশেই তিনি মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান হন। অথচ চাকরি বিধি অনুযায়ী একজন সরকারি চাকরিজীবী এভাবে দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে থাকতে পারেন না।
বদরুন নেছা লতা মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে বিদ্যালয়ে কর্ম ফাঁকি দিয়েছেন। যখন-তখন ছুটে গেছেন মহিলা সংস্থার বিভিন্ন কর্মসূচিতে। ফলে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনা ও শিক্ষার মানোন্নয়ন ব্যাহত হয়েছে। গত জানুয়ারিতে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও তার কিছুই হয়নি।
কয়েকজন অভিভাবক ঘটনার আড়ালে-কে জানান, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও বদরুন নেছা লতার দৌরাত্ম্য বন্ধ হয়নি। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ১০০ টাকা করে আদায় করা হয়েছে। এ ছাড়া গত ৯ সেপ্টেম্বর বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে অভিভাবক সভা ডাকেন প্রধান শিক্ষক। সভায় বিদ্যালয়ের নতুন ভবনের রেলিংয়ের ওপরে নিরাপত্তা বেষ্টনী স্থাপনের প্রস্তাব রাখা হয়।
এতে খরচ পড়বে লক্ষাধিক টাকা। আর পুরো টাকা দিতে হবে অভিভাবকদের। সন্তানের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তারা টাকা দিতে রাজি হয়েছেন। যদিও সরকারি বিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজে এভাবে অভিভাবকদের ওপরে টাকা চাপিয়ে দেওয়া যায় না। প্রতিষ্ঠানের যে কোন উন্নয়ন বা সংস্কার কাজে চাহিদার প্রেক্ষিতে অর্থ বরাদ্দ দেয় সরকার।
বিষয়টি নিয়ে জয়দেবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বদরুন নেছা লতার সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করলে তিনি বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
এ ব্যাপারে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মাসুদ ভূঁইয়া ঘটনার আড়ালে-কে বলেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফি নেওয়ার কোন নিয়ম নেই। তবে স্কুল কর্তৃপক্ষ ড্রেস ও ব্যাজ নির্ধারণ করলে বাচ্চারা বাইরের দোকান থেকে কিনে নেবে।