গাজীপুরের সালনা ভূমি অফিসে ঘুষ বাণিজ্য জমে উঠেছে, দালালদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে

ঘটনার আড়ালে প্রতিবেদন : গাজীপুরের সালনা ভূমি অফিসে উমেদার নামধারী দালালদের দৌরাত্ম্য আবার বেড়েছে। কর্মকর্তারাও ঘুষ বাণিজ্যে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।
ফলে সেবাপ্রার্থীদের পোহাতে হচ্ছে হয়রানি ও ভোগান্তি। এসব প্রতিরোধে কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন জনসাধারণ।
সরেজমিনে জানা যায়, নগরীর সালনা ভূমি অফিস ঘিরে দীর্ঘদিন ধরে একটি দালাল চক্র রয়েছে। যখন যে কর্মকর্তারা চেয়ারে বসেন, চক্রটি তাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলে। যেসব কর্মকর্তা টাকার নেশায় বেপরোয়া, তারা চক্রের সদস্যদের কাছে টেনে নেন।
সুযোগ পেয়ে দালালরা অফিসের ভেতরে সরকারি কর্মচারীর মত জমির নামজারি ও জমাভাগের ফাইল তৈরি এবং খাজনা আদায়ের কাজ করেন। পাশাপাশি তাদেরকে দিয়ে মিসকেসের প্রতিবেদনও প্রস্তুত করা হয়।
সালনা ভূমি অফিসে আগে কাপাসিয়ার আলমের বেশ দৌরাত্ম্য ছিল। ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মাহ্ আলমের সময়ে তিনি ব্যাপক বাণিজ্য করেছেন।
বিষয়টির ওপর গত ৫ নভেম্বর ঘটনার আড়ালে-তে একটি তথ্যবহুল প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর দালাল আলমের দৌরাত্ম্য কমে যায়। অভিযুক্ত মাহ্ আলমকেও ১৪ নভেম্বর কাপাসিয়ার তরগাঁও ইউনিয়ন ভূমি অফিসে বদলি করে জেলা প্রশাসন।
তখন তরগাঁও ইউনিয়ন ভূমি অফিস থেকে সালনা ভূমি অফিসে যোগ দেন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা আক্কাস আলী। যোগ দিয়েই তিনি দালাল আলমের বিকল্প হিসেবে দালাল লুৎফর রহমানকে বেছে নেন।
লুৎফর দক্ষিণ সালনা গ্রামের আবদুল হামিদের ছেলে। তিনি প্রায় দুই যুগ ধরে বাড়ির কাছের এই ভূমি অফিসে দালালি করছেন। গড়ছেন মোটা অঙ্কের অর্থ-সম্পদ।
নায়েব আক্কাস আলীর আশ্রয় পেয়ে দালাল লুৎফরের দৌরাত্ম্য এখন বেড়েছে। তিনি নিয়মিত অফিসের ভেতরে থাকেন। যখন-তখন অফিসের আলমারি খুলে নথিপত্র বের করেন। ভলিয়ম নিয়ে বাড়িতেও চলে যান।
সেবাপ্রার্থীরা ভূমি সহকারী কর্মকর্তা আক্কাস আলীর সঙ্গে দেখা করলে তিনি লুৎফরকে দেখিয়ে কথা বলতে বলেন। বড় লেনদনের কাজের বিষয়ে নায়েব নিজে চুক্তি করেন। বাকিগুলো দালাল লুৎফর ও ভূমি উপ-সহকারী কর্মকর্তা বেগম শেফালী আক্তারের মাধ্যমে হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সালনা ভূমি অফিসে সাধারণ খারিজে ৩ হাজার টাকা থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা নেওয়া হয়। বড় কাজে ২০-৩০ হাজার টাকা থেকে লাখ টাকাও লাগে। টাকা না দিলে নানা ভুল-ত্রুটি ধরে হয়রানি করা হয়। এভাবে মাসে মোটা অঙ্কের টাকার বাণিজ্য হচ্ছে।
সূত্র আরও জানায়, নায়েব আক্কাস আলী বন্ধের দিন দালাল লুৎফরকে নিয়ে অফিসে কাজ করেন। অন্যান্য দিন উত্তর সালনা এলাকার দালাল বেলায়েত, ভাওরাইদ এলাকার দালাল রওশন আরা ও দালাল আলম বিকেল পাঁচটার দিকে অফিসে ঢুকে চুক্তিতে নেওয়া কাজ আক্কাস আলীকে বুঝিয়ে দেন।
এ ব্যাপারে ভূমি সহকারী কর্মকর্তা আক্কাস আলী ঘটনার আড়ালে-কে বলেন, অফিসে কোন উমেদার আসে না। তবে লুৎফর উমেদারদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো।
এদিকে ভূমি উপ-সহকারী কর্মকর্তা শেফালী আক্তার ব্যাপক খাজনা বাণিজ্যে মেতেছেন। তাকে দাবিকৃত টাকা দিলে আবাসিক জমির শ্রেণি হয়ে যায় ২ টাকা শতাংশের কৃষি বা চালা। আর টাকা না দিলে কৃষি শ্রেণির জমিকে ৬০ টাকা শতাংশের আবাসিক উল্লেখ করে কয়েক গুণ বেশি টাকা আদায় করা হয়।
কাউলতিয়া মৌজার আফজাল হোসেন আশিক গত ৩ জানুয়ারি সোয়া ৫ শতাংশ জমির ভূমি উন্নয়ন কর দিতে অফিসে যান। তার জমির শ্রেণি চালা হলেও ব্র্যাকেটে আবাসিক লিখে ২ হাজার ৪৯৯ টাকা দাবি করা হয়। পরে তিনি চুক্তিতে না গিয়ে তা-ই পরিশোধ করেন।
টেকিবাড়ী মৌজার রাশেদ হোসেন গং গত ২৮ মার্চ প্রায় ৩০ শতাংশ জমির খাজনা দিয়েছে। বকেয়া ছিল ৮ বছরের। তাতে আবাসিক জমির শ্রেণি কারসাজির মাধ্যমে সরকারকে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে মাত্র ১ হাজার ৪ টাকার রসিদ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ।
দক্ষিণ সালনা মৌজার আমিনুল ইসলাম ও প্রতিবেশী আতাউর রহমান জমির খাজনা দিতে গত ২৮ জানুয়ারি ভূমি অফিসে যান। নায়েব শেফালী আক্তার তাদের কাছ থেকে ৬ হাজার টাকা নিয়ে ৯৪৯ টাকার পৃথক রসিদ দেন। তারা কারণ জানতে চাইলে বলা হয়, নিয়ম মেনে খাজনা দিলে টাকা আরও বেশি হবে। কম নেওয়া হয়েছে, অফিসের খরচ আছে।
এ ব্যাপারে ভূমি উপ-সহকারী কর্মকর্তা বেগম শেফালী আক্তারের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি কল ধরেননি।
সচেতন মহল বলছেন, জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম সেবাপ্রার্থীদের হয়রানি প্রতিরোধে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। এতে ভূমি প্রশাসনে নৈরাজ্য কমেছে। কিন্তু অতি লোভী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কারণে কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলছে না।
উল্লেখ্য, অভিযুক্ত কর্মকর্তারা কোটিপতি নায়েব হিসেবে পরিচিত। তারা ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে বাড়ি-গাড়িসহ বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সেসব তুলে ধরতে ঘটনার আড়ালের টিম কাজ করছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button