গাজীপুর জেলা রেজিস্ট্রারের রেকর্ড রুমে মাসে কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য
ঘটনার আড়ালে প্রতিবেদন : গাজীপুর জেলা রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের রেকর্ড রুমে ব্যাপক ঘুষ-দুর্নীতি চলছে। এ নিয়ে তল্লাশিকারকরা একাধিকবার কর্মবিরতি কর্মসূচি পালন করলেও কর্তৃপক্ষ কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি।
সরেজমিনে জানা যায়, জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয় আগে ছিল নগরীর জোড়পুকুর মোড়ের অল্প উত্তরে। ভাড়া ভবনটির নিচ তলায় দ্বিতীয় যুগ্ম সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যক্রম এখনো চলমান। গত শুক্রবার জমির দলিলের সইমোহর নকল তোলার রেকর্ড রুম মারিয়ালী এলাকার নবনির্মিত ভবনে স্থানান্তর করা হয়েছে।
সেবাপ্রার্থীরা নকলের জন্য তল্লাশিকারকদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ২০ টাকার কোর্ট ফি ও স্ট্যাম্প দিয়ে আবেদন করা হয়। একই সঙ্গে রেকর্ড কিপারের কাছে প্রতি নকলে ১৩৫০ টাকা করে জমা দিতে হয়।
জমির রেজিস্ট্রিকৃত মূল্য ও পাতা অনুযায়ী নকলপ্রতি গড়ে সরকার রাজস্ব পায় ৪০০-৫০০ টাকা। বাকি ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা ঘুষ হিসেবে জমা হয়।
বর্তমান রেকর্ড কিপার শামীমা সুলতানা এক বছর আগে যোগদান করেছেন। তার চেয়ারের পাশে বসে একাধিক নকলনবিশ টাকা আদায় করে হিসাব বুঝিয়ে দেন।
রেকর্ড রুমের দায়িত্বে আছেন গাজীপুর সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের সাব-রেজিস্ট্রার জাহাঙ্গীর আলম। একই সঙ্গে তিনি যুগ্ম সাব-রেজিস্ট্রি অফিসেরও অতিরিক্ত দায়িত্বে আছেন।
বাণিজ্য পৌনে এক কোটি :
যুগ্ম অফিসসহ গাজীপুর রেকর্ড রুমে দৈনিক ৪০০-৫০০ নকলের আবেদন জমা পড়ে। সরকারি ছুটি বাদ দিলে মাসে আবেদন পড়ে আট হাজার থেকে ১১ হাজার। নকলগুলো থেকে গড়ে ৮৫০ টাকা করে মাসে আদায়কৃত ঘুষের পরিমাণ দাঁড়ায় পৌনে এক কোটি টাকার বেশি।
স্বাক্ষর বাবদ নকলের সংখ্যা গুণে এই বিপুল টাকার বড় অংশ নেন সাব-রেজিস্ট্রার। বাকি টাকা থেকে রেকর্ড কিপারসহ অন্যরা পদ অনুযায়ী ভাগ পান।
তল্লাশিকারকরা জানান, দুর্নীতির দায়ে পলাতক সাবেক সাব-রেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলামের আমল থেকে ওই রেট ছিল ১১০০ টাকা। বর্তমান সাব-রেজিস্ট্রার গত জুলাইয়ে ২০০ টাকা বাড়িয়ে ১৩০০ টাকা নির্ধারণ করেন। পরে তল্লাশিকারক সমিতি তাদের ফান্ডে কিছু সহযোগিতার দাবি জানালে আরও ৫০ টাকা বাড়ানো হয়।
তারা আরও জানান, আগস্ট মাসে বাড়তি ৫০ টাকা থেকে সমিতি নকলপ্রতি ৪০ টাকা করে পেয়েছে। বাকি ১০ টাকায়ও ভাগ বসিয়েছেন সাব-রেজিস্ট্রার জাহাঙ্গীর আলম।
কয়েকজন সেবাপ্রার্থী জানান, আগে কম টাকায় দলিলের নকল পাওয়া যেত। পর্যায়ক্রমে ঘুষের রেট বাড়ায় এখন আড়াই হাজার টাকার নিচে নকল তোলা যায় না। এতে মানুষের ভোগান্তি অনেক বেড়েছে।
উমেদারদের দৌরাত্ম্য :
রেকর্ড রুমে দৈনিক ৬০ টাকা মজুরি ভিত্তিতে আটজন উমেদার নিয়োগ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তাদের মধ্যে সোহেল, কাশেম, রিপন ও রাব্বি বেপরোয়া। সোহেল দুদকের মামলার আসামি সাব-রেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলামের লোক ছিলেন বলে প্রচার রয়েছে।
একাধিক তল্লাশিকারক জানান, বালাম বই অনেক আগের হলে উমেদার সোহেল, কাশেম, রিপন ও রাব্বিকে ৫০০-১০০০ টাকা দিতে হয়। টাকা না দিলে বই পাওয়া যায় না। তারা নিজেরাও লোকজনের সঙ্গে নকল দেওয়ার চুক্তি করেন।
অফিস স্থানান্তরের নামে সেবা বন্ধ :
গাজীপুর রেকর্ড রুম মারিয়ালীতে স্থানান্তর নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষের সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে কর্তৃপক্ষ গত ৬ সেপ্টেম্বর থেকে জেলা ও সদরের নকলের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। এতে একদিকে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অপরদিকে নকল তুলতে না পারায় জমিজমা সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রয়োজনে জনসাধারণ ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়েছেন।
তল্লাশিকারক ও দলিল লিখকরা জানান, নকলের কার্যক্রম মৌখিক নির্দেশে বন্ধ করা হয়েছে। কোথাও কোন নোটিশ টানানো হয়নি। কবে কার্যক্রম চালু হবে, তা-ও কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন না। তবে যুগ্ম অফিসের নকলের কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে।
এ ব্যাপারে রেকর্ড কিপার শামীমা সুলতানা ঘটনার আড়ালে-কে বলেন, সবার সঙ্গে আলোচনা করে নকলের রেট ১৩৫০ টাকা করা হয়েছে। আর নতুন ভবনে সব গোছানো হয়ে গেলে নকলের কাজ শুরু হবে।
অভিযুক্ত সদর ও যুগ্ম সাব-রেজিস্ট্রার জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
জেলা রেজিস্ট্রার সাবিকুন নাহার ঘটনার আড়ালে-কে বলেন, আইন অনুযায়ী নকলে ১৩৫০ টাকা নির্দিষ্ট হওয়ার কথা না। দলিলের পৃষ্ঠার ওপরে নির্ভর করে কোনটা ৭০০ টাকা, কোনটা ৮০০ টাকা আসবে। একই আসবে না। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখা হবে।