গাজীপুরের ন্যাশনাল পার্কের পরিবেশ বিনষ্ট ও বন্যপ্রাণীর ক্ষতি ধামাচাপার পাঁয়তারা

ঘটনার আড়ালে প্রতিবেদন : গাজীপুরের ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের পরিবেশ বিনষ্ট ও বন্যপ্রাণীর ক্ষতিসাধনের অভিযোগে হাতেনাতে আটক দুটি ময়লার গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা ধামাচাপার পাঁয়তারা চলছে।
এরই অংশ হিসেবে অভিযুক্তরা টাকা দিয়ে অন্য পত্রিকায় কথিত প্রতিবাদ বিজ্ঞপ্তি ছাপিয়েছেন। প্রতিবাদ বিজ্ঞপ্তি পেয়ে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা শারমীন আক্তারও নীরব ভূমিকা পালন করছেন।
এর আগে বিষয়টির ওপর গত ৬ মে ঘটনার আড়ালের প্রিন্ট ও ৭ মে ঘটনার আড়ালের অনলাইন সংস্করণে একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। পরে ডিএফওর নির্দেশের কথা বলে পার্ক রেঞ্জ কর্মকর্তা কাজী নাজমুল হক ও পার্ক বিট কর্মকর্তা শাহান শাহ আকন্দ এক দালাল সাংবাদিককে দিয়ে প্রতিবাদ বিজ্ঞপ্তি ছাপানোর ব্যবস্থা করেন।
অভিযোগনামা : ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান কোর জোনভুক্ত সংরক্ষিত এলাকা। এই পার্কের ৬ নম্বর গেটের উত্তর পাশ ঘেঁষে দীর্ঘদিন ধরে ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। আর সেসবে থাকা উচ্ছিষ্ট খেয়ে বানরসহ অন্যান্য প্রাণী রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। ঘটছে পরিবেশগত মারাত্মক দূষণ।
রাজেন্দ্রপুর ক্যান্টনমেন্ট এলাকার ময়লার ঠিকাদার সোহেল রানাসহ কয়েকজন বিভিন্ন স্থান থেকে বর্জ্য গাড়িযোগে এনে পার্কের পাশে ফেলেন। এর ফলে সেখানে ময়লার স্তূপ জমে উন্মুক্ত ভাগাড় সৃষ্টি হয়েছে। বিনিময়ে তারা প্রত্যেকে পার্ক বিট অফিসে মাসে ১০ হাজার টাকা করে দেন বলে অভিযোগ।
গত ২২ এপ্রিল সন্ধ্যার দিকে সহকারী বন সংরক্ষক মোজাম্মেল হোসেন ময়লাবাহী একটি টমটম গাড়ি আটক করে পার্ক রেঞ্জ কর্মকর্তাকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। এরপর আরেকটি ময়লার গাড়ি আটক করেন রেঞ্জ কর্মকর্তা।
দুটি গাড়িই ঠিকাদার সোহেলের। পরে সোহেল তদবির করে গত ৩০ এপ্রিল রাতে পার্ক রেঞ্জের ক্যানটিনের পাশে রাখা গাড়ি দুটি ছাড়িয়ে নেন। কারও বিরুদ্ধে কোন মামলা করা হয়নি।
অভিযোগ রয়েছে, ঠিকাদার সোহেল কর্মকর্তাদের সঙ্গে লেনদেন করে গাড়ি ছাড়িয়ে নিয়েছেন। বোটম্যান কবির হোসেনের সহযোগিতায় গাড়ি দুটিতে থাকা বর্জ্যও পার্কের গভীরে নিয়ে খালাস করা হয়েছে। কবির হোসেন প্রায় ১৫ বছর ধরে পার্ক বিটে ডেপুটেশনে থেকে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন।
অপরদিকে ঘটনার আড়ালে-তে প্রকাশিত প্রতিবেদনের বিষয়ে একটি প্রতিবাদপত্র পাঠিয়েছেন পার্ক বিট কর্মকর্তা শাহান শাহ আকন্দ। তাতে বলা হয়, ন্যাশনাল পার্ক সংলগ্ন স্থানে সিটি করপোরেশনের ২২ নং ওয়ার্ড ও রাজেন্দ্রপুর ক্যান্টনমেন্ট এলাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য দীর্ঘদিন যাবত প্রতিনিয়ত ফেলা হচ্ছে। এতে পার্কে আগত দর্শনার্থী, এলাকাবাসী ও পথচারীদের পথ চলতে খুবই কষ্ট হচ্ছে।
বিষয়টি জেলা উন্নয়ন ও সমন্বয় কমিটির সভায় উপস্থাপন করা হয়েছে। উক্ত স্থানে বর্জ্য না ফেলার জন্য বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন), ২০১২-এর ১৪ ধারা অনুযায়ী নির্দেশনা সংবলিত সাইনবোর্ড স্থাপন এবং সদর থানায় ২০২৩ সালের ৩১ জুলাই একটি সাধারণ ডাইরি করা হয়েছে।
পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে যে ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। প্রকৃতপক্ষে রেঞ্জ ও বিট কর্মকর্তা নিয়মিত টহলকালে ঘটনাস্থলে বর্জ্য ফেলা অবস্থায় টমটম গাড়ি ও লোকজন দেখতে পেয়ে তাদের কঠোরভাবে সতর্ক করেন। বর্জ্য ফেলা বন্ধ না করলে বন্যপ্রাণী আইন অনুয়ায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানানো হয়। তাদের কাছ থেকে কোন প্রকার টাকা আদায় বা গাড়ি আটক করা হয়নি। তিনি প্রকাশিত প্রতিবেদনের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।
প্রতিবেদকের বক্তব্য : আলোচিত প্রতিবেদনটি সরেজমিনে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রকাশিত হয়েছে। এসিএফ প্রথমে যে ময়লাবাহী টমটম গাড়ি আটক করেন, সেটা রেঞ্জ কর্মকর্তা কাজী নাজমুল হক ওই দিন রাতে ঘটনার আড়ালের কাছে স্বীকার করেছেন।
গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার পর বিট কর্মকর্তা শাহান শাহ আকন্দের কাছে যখন জানতে চাওয়া হয়, তিনিও ঘটনা সরাসরি অস্বীকার করেননি। অভিযুক্ত ঠিকাদার সোহেলও তার আটক দুটি গাড়ি ও লোক ছাড়িয়ে নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। এসব প্রমাণ ঘটনার আড়ালের কাছে সংরক্ষিত আছে।
এ ছাড়া পৃথক সময়ে আটককৃত গাড়ি দুটি পার্কের ভেতরে নিয়ে রাখা হয়। সেই ছবিও প্রতিবেদনের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে। এত কিছুর পরও সব ভিত্তিহীন দাবি করা চরম মিথ্যাচারের নামান্তর।
বিট কর্মকর্তা প্রতিবাদপত্রে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২-এর যে ১৪ ধারার কথা উল্লেখ করেছেন, সেটা জামিন অযোগ্য অপরাধ। তিনি নিজেই বলেছেন, ওই স্থানে দীর্ঘদিন ধরে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে এবং বর্জ্য ফেলা অবস্থায় টমটম গাড়ি ও লোকজন পেয়ে সতর্ক করা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হল, দীর্ঘদিন ধরে চলা জামিন অযোগ্য অপরাধের প্রতিকার কী শুধুই সতর্ক করা? বর্জ্য ফেলা অবস্থায় পেয়েও বর্জ্য অপসারণে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন? আইনে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকার পরও মামলা না করার রহস্য কী?

আরও পড়ুন : গাজীপুরের ন্যাশনাল পার্ক ঘেঁষে ময়লার ভাগাড়, আটক গাড়ি ছাড়লেন রেঞ্জার-ফরেস্টার!

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button