গাজীপুরে প্রকল্পের টাকা লুটেপুটে ছিদ্দিক চেয়ারম্যানের বাজিমাত, থমকে আছে দুদকের তদন্ত

ঘটনার আড়ালে প্রতিবেদন : গাজীপুরে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে বেশ আলোচিত হয়ে উঠেছেন আবু বকর ছিদ্দিক। তিনি সদর উপজেলার ভাওয়ালগড় ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও তার অঘটন ভাইরালে রূপ নিয়েছে।

অনুসন্ধানী সাপ্তাহিক ঘটনার আড়ালে প্রভাবশালী আবু বকর ছিদ্দিকের মুখোশ উন্মোচন করছে। এরই মধ্যে রাজনৈতিক ভেলকিবাজি ও শিল্পাঞ্চলের ঝুট ব্যবসা দখলের ওপর দুটি তথ্যবহুল প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্পের নামে সরকারি সহায়তার লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের চিত্র নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের তৃতীয় পর্ব আজ।

আবু বকর ছিদ্দিক ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের ১১ জুন পর্যন্ত পাঁচ বছর ভাওয়ালগড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। নির্বাচনের সময় তিনি জনগণের কাছে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন ও নানামুখী উন্নয়নের অঙ্গীকার করেছিলেন। ভোটাররা অগাধ বিশ্বাস নিয়ে তাকে নির্বাচিত করেন।

আবু বকর ছিদ্দিক স্থানীয় সরকারের চেয়ারে বসে প্রথমে স্বাভাবিকভাবেই চালাচ্ছিলেন পরিষদ। পরে বিভিন্ন কাজে কাঁচা টাকার গন্ধে তিনি হুঁশ হারান। শুরু হয় মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার মিশন।

আবু বকর ছিদ্দিক তার আমলে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন। ঘটনার আড়ালের অনুসন্ধানে ওঠে আসছে নানা ফিরিস্তি। ইউনিয়নজুড়ে বহুসংখ্যক প্রকল্পের মধ্যে কোথাও অর্ধেক কাজ হয়েছে, কোথাও কাজ না করেই সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে, কোথাও শিল্প কারখানা থেকে চাঁদা নেওয়া হয়েছে।

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক সংলগ্ন বানিয়ারচালা এলাকার মেম্বারবাড়ী বাসস্ট্যান্ড থেকে পূর্ব দিকে পানি নিষ্কাশনের ড্রেন নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয় ২০২২-২৩ অর্থবছরে। এতে স্থানীয় সরকার সহায়তা তহবিল (এলজিএসপি) থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৭ লাখ ২১ হাজার ৬৮৩ টাকা। ড্রেনটির দৈর্ঘ্য ধরা হয় ১০০ মিটার অর্থাৎ ৩২৮ ফুট।

পরে চেয়ারম্যান আবু বকর ছিদ্দিকের পরিকল্পনায় অর্ধেক কাজ করে পুরো বিল উত্তোলন করা হয়। বাকি কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় বেড়ে যায় দুর্ভোগ। এক পর্যায়ে স্থানীয় কয়েকজনের উদ্যোগে বাসিন্দাদের কাছ থেকে টাকা তুলে অবশিষ্ট কাজ সম্পন্ন করা হয়। বর্তমান চেয়ারম্যানের আমলে ড্রেনের দৈর্ঘ্য আরও বেড়েছে।

ভবানীপুর স্কুলের দক্ষিণ দিকে হেরিং বোন বন্ড (এইচবিবি) রাস্তার জন্য ২০২২ সালে এলজিএসপি তহবিল থেকে বরাদ্দ হয় ১ লাখ ৮৬ হাজার ৮৪৪ টাকা। রাস্তাটির দৈর্ঘ্য ধরা হয় ৫৪ মিটার অর্থাৎ ১৭৭ ফুট। কিন্তু মাত্র ১০ ফুট কাজ করেই পুরো বিল উত্তোলন করা হয়েছে।

মাত্র ১০ ফুট হেরিং বোন রাস্তা ইটের সলিংয়ের সঙ্গে মিশেছে। বাকি ১৬৭ ফুট রাস্তার কাজ করা হয়নি।

স্থানীয় জাকির খান ও জজ মিয়া ঘটনার আড়ালে-কে জানান, এই রাস্তা দিয়ে স্কুলের শিক্ষার্থী ও শতাধিক বাড়ির মানুষ চলাচল করে। গত দুই বছরেও রাস্তার কাজ আর হয়নি।

২০২১-২২ অর্থবছরে একই তহবিল থেকে ভবানীপুরের সাফারি পার্ক রোড থেকে রবিনের বাড়ি অভিমুখী হেরিং বোন রাস্তার জন্য বরাদ্দ হয় ৩ লাখ ২০ হাজার ১৬৪ টাকা। রাস্তাটির দৈর্ঘ্য ধরা হয় ৮৬ মিটার অর্থাৎ ২৮২ ফুট। এর মধ্যে কাজ হয়েছে ১৫০ ফুট। পুরো কাজ না করেই বিল উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়েছে।

সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে সম্পাদিত দলিলসমূহ থেকে অর্জিত সরকারি ফি অর্থাৎ স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর করের শতকরা ১ ভাগ পায় সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ। এই খাত থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ভবানীপুর এলাকার কামালের বাড়ি থেকে রিজভীর বাড়ির দিকের মসজিদ অভিমুখী রাস্তার পাইপ ড্রেন প্রকল্পে ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়। কিন্তু কোন কাজ না করেই পুরো বিল উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়েছে।

স্থানীয় সাত্তার মোল্লা ঘটনার আড়ালে-কে জানান, মেম্বার-চেয়ারম্যান ড্রেন করার কথা বললেও করেননি। তারা কয়েকজন উদ্যোগ নিয়ে বাড়িপ্রতি ১০-১৫ হাজার টাকা করে তুলে ১২ ইঞ্চি প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে ড্রেন নির্মাণ করেছিলেন। গাড়ির চাপায় বিভিন্ন জায়গায় পাইপ নষ্ট হওয়ায় এখন পানি নিষ্কাশন হয় না।

একই অর্থবছরে স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর করের তহবিল থেকে ভবানীপুর উত্তরপাড়ার জয়নাল আবেদীনের বাড়ি থেকে মৃত তোফাজ্জলের বাড়ি অভিমুখী ইটের সলিং রাস্তার জন্য বরাদ্দ হয় ২ লাখ টাকা। কিন্তু কাজ হয়েছে মাত্র ৬০ ফুট রাস্তার। বরাদ্দের পুরো কাজ না করেই বিল উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়েছে।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে একই তহবিল থেকে ভবানীপুরের ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে তাইজ উদ্দিনের বাড়ি অভিমুখী রাস্তায় আরসিসি কাস্টিংয়ের জন্য ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও রাস্তাটির সন্ধান পাওয়া যায়নি।

মহাড়কের পশ্চিম পাশে কুমিল্লা হোটেলের পেছনে ওই তাইজ উদ্দিনের বাড়ি। তার ভাই মুসা প্রধান ঘটনার আড়ালে-কে জানান, তারা সেখান দিয়ে একটি রাস্তা হওয়ার কথা শুনেছিলেন। পরে আর হয়নি।

একই তহবিল থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে ভৌড়াঘাটা পাকা রাস্তা থেকে আশ্রয়ণ প্রকল্প অভিমুখী হেরিং বোন রাস্তার জন্য বরাদ্দ হয় দুই লাখ টাকা। কিন্তু রাস্তাটিতে হেরিং বোনের বদলে করা হয়েছে সলিং।

এ ছাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পে বালু ভরাটের জন্য ২০২২ সালে কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) কর্মসূচির আওতায় ৭ টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ দেয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। প্রকল্পের বাসিন্দারা এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না।

ভৌড়াঘাটা আশ্রয়ণ প্রকল্প সমবায় সমিতির সভাপতি মো. কাউসারসহ কয়েকজন ঘটনার আড়ালে-কে জানান, এই আশ্রয়ণ প্রকল্পে কোন বালু ভরাট করা হয়নি। স্থানটি নিচু হওয়ায় বৃষ্টি হলেই পানি জমে। দুর্ভোগের বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনকে জানানো হয়েছে।

২০২১-২২ অর্থবছরে উন্নয়ন সহায়তা তহবিল থেকে শিরিরচালা এলাকার সোবহান মুন্সি সড়কে হেরিং বোন প্রকল্প নেওয়া হয়। বরাদ্দ হয় ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। রাস্তাটির ১০০ ফুট পর্যন্ত কাজ করেই পুরো বিল উত্তোলন করা হয়েছে।

একই অর্থবছরে স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর করের তহবিল থেকে পূর্ব নয়াপাড়া এলাকার হাসেমের বাড়ি থেকে নয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় অভিমুখী ইটের সলিং রাস্তার জন্য ২ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়। নির্মাণ কাজে ব্যবহার করা হয় নিম্নমানের সামগ্রী।

নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করায় সলিং ভেঙে যাচ্ছে

স্থানীয় রতন মাস্টারসহ কয়েকজন ঘটনার আড়ালে-কে জানান, রাস্তাটির কাজে দুই নম্বর ও তিন নম্বর ইট ব্যবহার করা হয়েছে। এই রাস্তা দিয়ে অটোরিকশা ব্যতীত ভারী যানবাহন চলাচল করে না। এরপরও দ্রুত সলিং ভেঙে যাচ্ছে।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে একই তহবিল থেকে রক্ষিতপাড়া এলাকার আমিরের বাড়ির পাশে কালভার্ট নির্মাণের জন্য বরাদ্দ হয় ১ লাখ টাকা। কিন্তু এই বরাদ্দের কোন কালভার্ট পাওয়া যায়নি। কাজ না করেই বিল উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, তারা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে একটি কালভার্ট করার কথা শুনলেও কালভার্ট নির্মাণ করা হয়নি। সেখানে ওই অর্থবছরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রায় পৌনে ১৪ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি ছোট ব্রিজ করা হয়েছে।

একই তহবিল থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে রক্ষিতপাড়া মসজিদ থেকে মনিরের বাড়ি অভিমুখী ইটের সলিং রাস্তার জন্য ১ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়। রাস্তাটির কোন কাজ না করেই বিল উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়েছে।

বাস্তবে না থাকলেও কাগজে-কলমে রাস্তার কাজ সম্পন্ন

মনির হোসেন ঘটনার আড়ালে-কে জানান, তিনি শুনেছিলেন যে তার বাড়ি অভিমুখী ইটের সলিং হবে। কিন্তু সেই রাস্তা আর হয়নি।

২০২১-২২ অর্থবছরে একই তহবিল থেকে নয়নপুর মন্ডল মার্কেট থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুনের বাড়ি অভিমুখী ইটের সলিং রাস্তার জন্য বরাদ্দ হয় ১ লাখ টাকা। বন বিভাগের বাধায় কাজ করতে না পারলেও বিল উত্তোলন করা হয়েছে।

কাজ না হওয়ায় ইট পড়ে থাকলেও বিল পড়ে থাকেনি

বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুনুর রশিদ ঘটনার আড়ালে-কে জানান, তিন গাড়ি ইট ও দুই গাড়ি বালু ফেলার পর বিট অফিসের লোকজন এসে কাজ বন্ধ করে দেন। পরে তিনি ইট তার বাড়ির পাশে স্তূপ করে রাখেন। দীর্ঘদিনেও কাজ আর হয়নি।

পাটপঁচা-ইজ্জতপুর রাস্তা থেকে পাটপঁচা মসজিদ অভিমুখী ৫০ ফুট ইটের সলিং হয়েছে। স্থানীয় রফিকুল ইসলাম মাস্টার সেখান থেকে রাস্তা তার বাড়ি অভিমুখী নেওয়ার জন্য আবু বকর ছিদ্দিকের শরণাপন্ন হন। চেয়ারম্যান ৪০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েও রাস্তা করেননি।

রফিকুল মাস্টার ঘটনার আড়ালে-কে জানান, আবু বকর ছিদ্দিক তার আত্মীয়। চেয়ারম্যানের অফিসে বসে তার দাবিকৃত ৪০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। বারবার তাগাদা দিলেও তিনি রাস্তা করেননি, টাকাও ফেরত দেননি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আবু বকর ছিদ্দিকের নেতৃত্বে এসব দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে। প্রকল্প কমিটির কতিপয় সভাপতি তার সহযোগী ছিলেন। তিনি বিএনপি নেতা হয়েও বেপরোয়া দুর্নীতির স্বার্থে আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রী ও স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। অনেকে তাকে আওয়ামী লীগের লোক হিসেবে দেখতেন।

তারা আরও জানান, আবু বকর ছিদ্দিকের দৃশ্যত বৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। চেয়ারম্যান পদে থেকে দুর্নীতি ও গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সদর উপজেলার শিল্পাঞ্চলের ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রক হয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন। তার কোটি কোটি টাকার গল্প এখন মুখে মুখে।

থমকে আছে দুদকের তদন্ত : আবু বকর ছিদ্দিক ও অন্যান্যদের বিরুদ্ধে প্রকল্প বাস্তবায়ন না করে প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য ২০২৩ সালে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করে দুর্নীতি দমন কমিশন। পরে দুদকের গাজীপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) জেলা কার্যালয়ের মাধ্যমে বেশকিছু নথিপত্র সংগ্রহ করে। যার ক্রমিক নম্বর ২৯/২০১৩।

এরপর দুদকের আর কোন তৎপরতার খবর পাওয়া যায়নি। ওপরে কথা বলে সব শেষ করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযুক্তদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। এ অবস্থায় দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন সচেতন মহল।

এ ব্যাপারে অভিযুক্ত আবু বকর ছিদ্দিকের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তিনি ঘটনার আড়ালে-তে প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রতিবাদ জানাতে গত মাসে হোতাপাড়া এলাকায় এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। এতে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোর কোন অংশ সরাসরি খণ্ডন না করে সব অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করা হয়।

আরও খবর

Back to top button