গাজীপুরের মনিপুর বিটে ফরেস্টারের সহায়তায় বনভূমি দখল, উচ্ছেদের নামে নাটক!

ঘটনার আড়ালে প্রতিবেদন : গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর রেঞ্জের মনিপুর বিট অফিসের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় মূল্যবান বনভূমি দখল করে বাড়িঘর নির্মাণ ও বিক্রি করা হচ্ছে।
ঢাকা বন বিভাগের মধ্যে অন্যতম দখলপ্রবণ এই বিটের বাণিজ্য নিয়ে ইতিমধ্যে ঘটনার আড়ালের প্রিন্ট ও অনলাইন সংস্করণে একাধিক সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এ নিয়ে কিছুদিন তোলপাড় চললেও শেষে অপরাধগুলো ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে।
ফলে বনভূমি দখলকারীরা আরও উৎসাহ পাচ্ছেন। বিভিন্ন স্থানে থেমে থেমে দখলও অব্যাহত রয়েছে।
সরেজমিনে জানা যায়, মনিপুর উত্তরপাড়া এলাকায় সিএস ৪৯২ নং দাগের প্রায় ১০ শতাংশ গেজেটভুক্ত বনভূমি দখল করে বারান্দাসহ তিন রুমের পাকা বাড়ি নির্মাণ করেছেন লোকমান হোসেন। গত মার্চে বাড়ির কাজ শুরু হলে ঘটনাটি রেঞ্জ কর্মকর্তা জুয়েল রানাকে জানানো হয়। পরে তিনি মনিপুর বিটের চলতি দায়িত্বে থাকা সালনা বিট কর্মকর্তা মোস্তানুর রহমান চৌধুরীকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন।
বিট কর্মকর্তা মোস্তানুর রহমান চৌধুরী প্রথমে কাজ বন্ধ করে দেন। কিছুদিন পর তাকে ম্যানেজ করে বাড়ির কাজ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করা হয়।
খবর পেয়ে সর্বশেষ অবস্থা জানালে রেঞ্জ কর্মকর্তা জুয়েল রানা ঘটনার আড়ালে-কে জানান, বিট কর্মকর্তা মোস্তানুর রহমান চৌধুরী ওই জমি জোত বলে তাকে জানিয়েছিলেন। মামলা দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্থাপনা নির্মাণের সুযোগ দেওয়ায় বনভূমি বেহাত হয়ে গেছে। এখন পিওআর মামলা আদালতে বছরের পর বছর ধরে চলবে। কিন্তু বনভূমি সহসা উদ্ধার হবে না। তাই উচ্ছেদ অভিযান ও দায়ী বিট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
বিট অফিস সূত্র জানায়, লোকমান হোসেন ওই জমির ডিমারকেশনের জন্য ২০১৪ সালে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু দাগটি বন বিভাগের নামে গেজেটভুক্ত থাকায় তার আবেদন নাকচ করা হয়। চলতি বছর সেখানে বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু হলে বনকর্মীরা একাধিকবার গিয়ে ইটের দেয়াল ভেঙে দেন। শেষে বিট কর্মকর্তা মোস্তানুর রহমান চৌধুরীর সহযোগিতায় কাজ সম্পন্ন হয়ে যায়।

লোকমানের বাড়ির কাজ চলাকালীন গত মার্চের চিত্র


এ ব্যাপারে মোস্তানুর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করলে তিনি ঘটনার আড়ালে-কে একবার বলেন, ব্যবস্থা নিয়েছি। আবার বলেন, কখন কোন সময় হয়তো কাজটা হয়ে গেছে। আমি মামলা দিয়েছি।
মনিপুর খাসপাড়া এলাকার কবরস্থানের পশ্চিম পাশে দখলকারী আকবর আলীর কাছ থেকে ছয় মাস আগে ছয় শতাংশ বনভূমি কিনেন স্থানীয় আলাউদ্দিন। পরে তিনি সেখানে দুটি প্লট করেন। একটি প্লটে টিনশেড বাড়ি নির্মাণ করে মনিপুরের এলিগেন্স পোশাক কারখানার কর্মকর্তা সাইদুর রহমানের কাছে চার লাখ ৬০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেওয়া হয়।
তিন মাস আগে আকাশমনি বাগানের কয়েকটি গাছ কেটে অপর প্লটে টিনশেড বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করেন আলাউদ্দিন। খবর পেয়ে রেঞ্জ কর্মকর্তা জুয়েল রানা গিয়ে বাধা দেন। কয়েক দিন পর বিট অফিসের সহযোগিতায় কাজ সম্পন্ন করে বাড়িটি হোটেল ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলীর কাছে পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেওয়া হয়।
গত ৪ জুন ঘটনার আড়ালে-তে প্রকাশিত প্রতিবেদনে আলাউদ্দিনের বনভূমি বেচাকেনার তথ্য তুলে ধরা হয়। দুই দিন পর রেঞ্জ কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে গিয়ে দখলকারীদের নিজ দায়িত্বে স্থাপনা ও মালামাল সরিয়ে নিতে দুই দিন সময় বেঁধে দেন। অন্যথায় অভিযান চালিয়ে সব ভেঙে মামলা দেওয়া হবে।
এরপর চলে গেছে ১৭ দিন। কোথাও উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়নি।
এরই মধ্যে বিটের বাগান মালি আমির হোসেনের নেতৃত্বে বনকর্মীরা দখলীয় স্থানে গিয়ে টিনের বাউন্ডারি খুলে মোবাইলে ছবি তুলেন। ফটোসেশন শেষে বাউন্ডারি ঠিক করা হয়। পরে কর্মকর্তারা সেই ছবি ওপরে পাঠিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে প্রতিবেদন জমা দেন।

আকাশমনি বাগানের ভেতরে বহাল মোহাম্মদ আলীর বাড়ি


ওয়াকিবহাল সূত্র জানায়, রেঞ্জ কর্মকর্তা হুঁশিয়ারি দেওয়ার পর অভিযুক্ত আলাউদ্দিন ও মোহাম্মদ আলী একাধিক ব্যক্তির কাছে দৌড়ঝাঁপ করেন। ঢালেন টাকা। পরে উচ্ছেদ কার্যক্রম থেমে যায়।
এদিকে খাসপাড়ায় মোহাম্মদ আলীর ‘মায়ের দোয়া হোটেল এন্ড রেস্তোরাঁ’ নামের দোকানও বনভূমিতে করা হয়েছে। তিনি আলাউদ্দিনের কাছ থেকে গত বছর প্রায় পৌনে এক কাঠা বনভূমি কিনে হোটেলের স্থাপনা নির্মাণ করেন। তখনও বিট অফিস কোন ব্যবস্থা নেয়নি।
পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, রক্ষকদের সহযোগিতা থাকায় মনিপুর বিটের দখল বাণিজ্য অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। বন রক্ষার স্বার্থে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কঠোর হওয়া জরুরি। নয়তো অবশিষ্ট বনাঞ্চল পর্যায়ক্রমে অস্তিত্ব হারাবে।

আরও পড়ুন : গাজীপুরের মনিপুর বিটে থেমে থেমে দখল বাণিজ্য, উচ্ছেদে অনীহা!

আরও খবর

Back to top button