গাজীপুরের কাশিমপুর ভূমি অফিসে ঘুষ বাণিজ্য, দালালও কোটিপতি!

আলোকিত প্রতিবেদক : গাজীপুরের কাশিমপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসে ঘুষ-দুর্নীতি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।

টঙ্গী রাজস্ব সার্কেলের আওতাধীন এই অফিসে ঘুষ লেনদেনে উমেদার নামধারী বেশ কয়েকজন দালালকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

তারা অফিসের চেয়ার-টেবিলে কম্পিউটার ও ল্যাপটপ নিয়ে সরকারি কর্মচারীর মত বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, কাশিমপুর জমিদার বাড়ির দক্ষিণ পাশে ভূমি অফিসটির অবস্থান। অফিসে ঢুকতেই পশ্চিম পাশে ছোট দুটি টেবিল। টেবিলে ল্যাপটপ নিয়ে দুই দালাল কাজ করছেন।

পশ্চিম পাশে দোতলার সিঁড়ি সংলগ্ন স্থানে তিনটি টেবিল। সেখানে একটি ল্যাপটপ ও একটি কম্পিউটারে কাজে ব্যস্ত তিন দালাল।

পূর্ব পাশের রুমে দুটি কম্পিউটার ও চেয়ারে চেয়ারে ব্যস্ত আরও চার দালাল। দালালদের দিয়ে জমির নামজারি ও জমাভাগ, খাজনা আদায় এবং মিস কেসের প্রতিবেদন তৈরির কাজ করানো হয়। বিভিন্ন এলাকার লোকজন সেবা নিতে এসে তাদের শরণাপন্ন হচ্ছেন।

আলোচিত দালালদের মধ্যে রয়েছেন আল-আমিন, তারেক, আজাদ ও প্রবীর চন্দ্র। তাদের মধ্যে আল-আমিন ভূমি উপ-সহকারী কর্মকর্তা আবদুর রহিমের টেবিলের সামনে, তারেক ভূমি সহকারী কর্মকর্তা লুৎফর রহমানের রুমে, আজাদ অফিসের বাউন্ডারির ভেতরে টিনশেড রুমে ও প্রবীর সিঁড়ি সংলগ্ন স্থানে বসে কাজ করেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আল-আমিনের পৈতৃক বাড়ি জামালপুরে। সাবেক ভূমি উপ-সহকারী কর্মকর্তা মাইনুল হক চৌধুরী প্রায় ১২ বছর আগে এলাকার ছেলে হিসেবে তাকে অফিসে স্থান দেন। এরপর তার দালালি জমে ওঠে। তিনি বর্তমানে সুরাবাড়ী এলাকায় জমি কিনে বাড়ি করে বসবাস করছেন।

দালাল তারেক ধনঞ্জয়খালী (নদীর পাড়) এলাকার খোদা বকসের ছেলে। তিনি অফিসে বসে ১০ বছর ধরে দালালি করছেন। আর সারদাগঞ্জ এলাকার আজাদ অফিসে বসে দালালি করছেন ১৫ বছর ধরে।

অপর দালাল প্রবীরের গ্রামের বাড়ি কাপাসিয়ার চাঁদপুরে। তিনি ১৮ বছর ধরে অফিসে বসে দালালি করছেন। গাজীপুর শহরের দক্ষিণ ছায়াবীথি এলাকায় জমি কিনে করেছেন বাড়ি।

ভুক্তভোগীরা জানান, জমির খারিজের আবেদন করার পর অফিসে যোগাযোগ করলে নায়েবরা উমেদারদের দেখিয়ে কথা বলতে বলেন। পরে উমেদারদের দাবি অনুযায়ী ঘুষ দিলে কাজ হয়ে যায়। নয়তো নানা ভুল-ত্রুটি ধরে হয়রানি করা হয়।

তারা আরও জানান, খাজনা পরিশোধের জন্য অনলাইনে আবেদন করার পর ভূমি অফিসে গিয়ে অনুমোদন করাতে হয়। তখন মূল জোতের খাজনা বেশি থাকলে নায়েবরা ঘুষের জন্য অনুমোদন না করে ঘোরান। টাকা দিলে খাজনার পরিমাণও কমে যায়।

উমেদারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কাশিমপুর ভূমি অফিসে ঘুষের বিভিন্ন রেট রয়েছে। সাধারণ খারিজ থেকে খারিজে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত তিন হাজার টাকা, ৫০ শতাংশের ওপরে ৫-১০ হাজার টাকা, মূল জমি থেকে খারিজে ১০ হাজার টাকা এবং অর্পিত সম্পত্তির অবমুক্ত হওয়া ‘খ’ তফসিলভুক্ত জমির খারিজে ১০-২০ হাজার টাকা করে দিতে হয়। এসিল্যান্ড অফিসের রেট আলাদা।

তারা আরও জানান, কাশিমপুর নগরীর অন্যতম শিল্প ও বাণিজ্যিক এলাকা। খারিজের আবেদনে জমির পরিমাণ বেশি থাকলে কিংবা পার্ট দাগ বা কাগজপত্রে কোন ত্রুটি থাকলে রেট বেড়ে ৫০ হাজার থেকে কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত হয়। এসব ওপেন সিক্রেট।

এসিল্যান্ড অফিস সূত্র জানায়, কাশিমপুর ভূমি অফিস থেকে মাসে ৩০০-৪০০ নামজারি ও জমাভাগের নথি আসে। এর মধ্যে কিছু থাকে ব্যক্তি বিশেষের, আর কিছু বাতিল। বাকিগুলো থেকে মোটা অঙ্কের টাকার বাণিজ্য হয়।

সূত্র আরও জানায়, ভূমি সহকারী কর্মকর্তা লুৎফর রহমান কাশিমপুর ভূমি অফিসে ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর যোগদান করেন। গত ২৩ অক্টোবর তার তিন বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। তিনি আদায়কৃত ঘুষের সিংহভাগ হাতিয়ে নিচ্ছেন। এ ছাড়া বড় বড় খারিজ তার নিজ চুক্তিতে হয়।

এদিকে একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের খারিজে ঘুষ লেনদেনের ঘটনায় গত সপ্তাহে অফিস সহায়ক শফিকুল ইসলাম খান ওরফে এস আই খানকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে জেলা প্রশাসন। তিনি ১৬-২০ গ্রেড সরকারি কর্মচারী সমিতির জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক।

একজন ভূমি কর্মকর্তা বলেন, ভূমি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জেলা প্রশাসনের রাজস্ব সভায় ভূমি অফিসে উমেদার না রাখার তাগিদ দেওয়া হয়। কিন্তু বাণিজ্যের স্বার্থে নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তাদের লালন করা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, কাশিমপুর ভূমি অফিস বড় লোভনীয় অফিস। যাদের অসৎ উদ্দেশ্য থাকে, তারা কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান। সেখানকার একাধিক উমেদারও কোটিপতি।

এ ব্যাপারে ভূমি সহকারী কর্মকর্তা লুৎফর রহমান অভিযোগ অস্বীকার করে আলোকিত নিউজকে বলেন, এখন উমেদার নেই বললেই চলে। অনলাইন চালু হওয়ায় উমেদারদের দরকার পড়ে না।

আরও খবর

Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker