শ্রীপুরে ৭ কোটি টাকার বনভূমি ৪০ লাখে বিক্রি!

আলোকিত প্রতিবেদক : আমি গরিব মানুষ। খাসে ঘর করে থাকি। টয়লেটের কুয়া খোঁড়ার সময় ফরেস্টার এসে ১০ হাজার টাকা দাবি করেন।

টাকা না দেওয়ায় স্ত্রী ও ছেলেসহ আমার বিরুদ্ধে পিওআর মামলা দেওয়া হয়। অথচ আমরা কোন গাছপালা কাটিনি।

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাধখলা এলাকার আমির আলী (৫৭) আলোকিত নিউজের কাছে এভাবেই বলছিলেন ক্ষোভের কথা।

তিনিসহ বেশ কয়েকজন প্রীতি গ্রুপের বনভূমি দখলের তাণ্ডব দেখিয়ে বলেন, শিল্পপতিরা বিঘার বিঘা খেয়ে ফেললেও মামলা বা উচ্ছেদ হয় না। আর টাকা না দিয়ে খালি জায়গায় টয়লেট বা ছোট কিছু করলেও আসামি হতে হয়।

অভিযুক্ত মনিরুল ইসলাম শ্রীপুর রেঞ্জের সিংড়াতলী বিট কর্মকর্তা। সম্প্রতি কালিয়াকৈরের ‘লোভনীয়’ মৌচাক বিট অফিসে তার বদলির আদেশ হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ৪৩ নং শ্রীপুর মৌজার পৌর এলাকা মাধখলার সিএস ১৮৯৩ নং দাগের বিপুল পরিমাণ জমি বন বিভাগের নামে গেজেটভুক্ত। গত বিএনপি সরকারের আমল থেকে গ্রাসের নানা তৎপরতা চালাচ্ছে প্রীতি গ্রুপ।

প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী তালুকদার। সেখানে তালুকদারের ভিটা নামে দুটি স্পট রয়েছে।

পশ্চিম দিকের স্পটে বন বিভাগের আগর বাগান ঘেঁষে বনভূমি প্রায় ১০ বিঘা। দখলের সময় চার ফুট উঁচু বাউন্ডারি ওয়াল করা হয়েছিল।

পরে ধীরে ধীরে তা ধসে পড়ে। চলতি বছরের মে ও জুনে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালুর উদ্দেশে চারদিকে ৮-১০ ফুট উঁচু বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণ করে দখল পোক্ত করা হয়।

বাউন্ডারির উত্তর পাশের অংশ

নিজেদের অটো ব্রিকস কারখানার দামি ইট দিয়ে নির্বিঘ্নে কাজ সম্পন্ন করে প্রীতি গ্রুপ। এরপর বাউন্ডারির ভেতরের কিছু গাছও কেটে নেওয়া হয়।

বাউন্ডারির পশ্চিম পাশের অংশ

কাজে অন্য নির্মাণ সামগ্রী ও শ্রমিক সরবরাহ করেন পাশের বৈরাগীরচালা এলাকার সবুর খান। তিনি প্রীতির ঠিকাদার হিসেবে পরিচিত।

বাউন্ডারির ভেতরে কেটে নেওয়া গাছের মোথা

পূর্ব দিকের স্পটে জমির পরিমাণ আনুমানিক ২০ বিঘা। সেখানে খননকৃত প্রায় এক বিঘা আয়তনের পুকুরসহ অর্ধেকেরও বেশি বনভূমি।

দখলের সময় বড় বড় গজারি গাছ কেটে বন উজাড় করে প্রীতি গ্রুপ। তখন থেকেই নীরব ভূমিকায় লিপ্ত হয় বন বিভাগ।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সেনাবাহিনীর সহায়তায় কাঁটাতারের বাউন্ডারি ও পাকা স্থাপনা ভেঙে ওই জমি উদ্ধার করা হয়েছিল। পরে তা আবারও দখল হয়।

বিট অফিস কয়েকবার উডলট বাগান করলেও প্রতিবারই চারা উঠিয়ে ফেলা হয়। সর্বশেষ ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ মৌসুমেও একই অবস্থা হয়।

গত অক্টোবরে ৪৬০টি আকাশমনি চারা রোপণ করে বিট অফিস। দুই-তিন দিন পর চারা উঠিয়ে লোহার খুঁটি পুঁতে সাড়ে চার বিঘা বনভূমিতে দামি নেট দিয়ে বেড়া দেওয়া হয়।

নেটের বেড়া দিয়ে বনভূমি দখল

এরপর সেখানে আম ও মাল্টা গাছের চারা রোপণ করে প্রীতি গ্রুপ। কিন্তু দখল বহাল রেখে এক পাশে কিছু চারা রোপণ করে দায় সারে বিট অফিস।

বেড়ার ভেতরে আম ও মাল্টা বাগান

স্পটটিতে বনভূমি ব্যতীত প্রবেশের কোন রাস্তা নেই। তাদের জোতভূমিরও ডিমারকেশনের কোন খুঁটি পাওয়া যায়নি।

ওয়াকিবহাল সূত্র জানায়, বিট কর্মকর্তা মনিরুল ইসলামকে হাত করে প্রথমে বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণ করা হয়। আখের গোছাতে তিনি আকাশমনি বাগানও বিক্রি করে দিয়েছেন।

সূত্র আরও জানায়, দুটি স্পটের ১৪ বিঘা বনভূমির স্থানীয় বাজারমূল্য অন্তত সাত কোটি টাকা। নতুন করে দখলে ৪০ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে বলে প্রচার রয়েছে।

একজন বন কর্মকর্তা বলেন, প্রীতি গ্রুপের দস্যুতায় পরিবেশেরও কয়েক কোটি টাকার ক্ষতিসাধন হয়েছে। রাষ্ট্রের সম্পদ লুণ্ঠনের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

তিনি আরও বলেন, ওই বিট কর্মকর্তা ঘুষ-দুর্নীতিতে সিদ্ধহস্ত। সুষ্ঠু তদন্ত হলে তার ভক্ষক রূপের অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে।

এদিকে ঘটনাটির ওপর গত ১ জুলাই আলোকিত নিউজ ডটকমে ‘শ্রীপুরে বনভূমি দখলে প্রীতি গ্রুপের তালুকদারি’ শিরোনামে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

এ নিয়ে চলে ব্যাপক তোলপাড়। পরে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইউছুপ তদন্ত করলেও উচ্ছেদ ও ক্ষতিপূরণের মামলাসহ দায়ীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

আলোকিত নিউজের প্রশ্নের জবাবে বিট কর্মকর্তা বলেছিলেন, প্রীতি গ্রুপের সাথে মামলায় বন বিভাগ রায় পেয়েছে। পরে তারা আপিল করলেও বিপক্ষে রায় বা কোন নিষেধাজ্ঞা পায়নি।

এ ব্যাপারে ডিএফও মোহাম্মদ ইউছুপের সাথে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি কল ধরেননি।

জেলা প্রশাসনের সূত্র জানায়, দেশ স্বাধীনের কয়েক বছর পর ১ নং খতিয়ানমূলে ১৮৯৩ নং দাগে ৪০ জনকে জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছিল। পরে দাগটি বন বিভাগের নামে গেজেটভুক্ত হওয়ায় খাজনা আদায় বন্ধ হয়ে যায়।

প্রীতি গ্রুপ পশ্চিম স্পটে ফুলেছা বানু ও মৃত সিরাজ উদ্দিনের কাছ থেকে নয় বিঘা জমি ক্রয় করেছে। অথচ বন্দোবস্তকৃত জমি আইনত বিক্রয় বা হস্তান্তর নিষিদ্ধ।

আরও খবর

Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker