গাজীপুরে বনভূমি দখলের উৎসব, কর্মকর্তারা অসহায়, উচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ দাবি
ঘটনার আড়ালে প্রতিবেদন : গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় দেদারসে বনভূমি দখল করা হচ্ছে। নির্মাণ করা হচ্ছে বাড়ি ও দোকানপাট। গাছ কেটে উজাড় করা হচ্ছে বন।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে সৃষ্ট অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সুযোগে এ দখলযজ্ঞ শুরু হয়। যা এখনো অব্যাহত রয়েছে।
জেলার ঢাকা বন বিভাগের চারটি এবং বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের দুটি রেঞ্জের সব কটিতেই দখলকারীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। রেঞ্জগুলোর অধিকাংশ বিটে ইতিমধ্যে বিঘার বিঘা বনভূমি দখল করে শত শত পাকা, আধা পাকা ও টিনশেড স্থাপনা গড়ে উঠেছে।
সরেজমিনে জানা যায়, অভ্যুত্থানের দিন সুবিধাবাদী দুর্বৃত্তরা বন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ওপর চড়াও হয়। তারা কালিয়াকৈর রেঞ্জ অফিসে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর, গুরুত্বপূর্ণ নথি ও রেকর্ডপত্র তছনছ, সরকারি গাড়ি ভাঙচুর, মোটরসাইকেলে আগুন এবং ১২টি রাইফেল লুট করে নিয়ে যায়। এতে অন্যান্য অফিসে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কয়েকটি অফিসের কর্মকর্তারা কৌশলে হামলা থেকে রক্ষা পান।
এমন অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে বন কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা মাঠ পর্যায়ে টহল এবং বনাঞ্চল রক্ষণাবেক্ষণের কাজে যেতে পারছেন না। কোথাও কোথাও দখলে বাধা দিতে গিয়ে আক্রমণাত্মক অবস্থার মুখে পড়তে হয়েছে। পুলিশ নিজেরা আক্রান্ত হওয়ায় বন বিভাগকে সহযোগিতা করতে পারছে না।
কালিয়াকৈর রেঞ্জ কর্মকর্তা মনিরুল করিম ঘটনার আড়ালে-কে বলেন, লুট হওয়া অস্ত্রগুলোর মধ্যে থানা পুলিশ তিনটি অস্ত্র উদ্ধার করেছে। হামলা পরিকল্পিত ছিল। যে অবস্থা হয়েছিল, অফিসে থাকলে তাদের মেরে ফেলা হত।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন জায়গায় বাগানের গাছ কেটে ঘর করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে গেলে নারী-পুরুষ জড়ো হয়ে হামলা চালাতে চায়। এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে।
কাঁচিঘাটা রেঞ্জ কর্মকর্তা সৈয়দ আমিনুর রহমান ঘটনার আড়ালে-কে বলেন, তার অফিসে হামলার পাঁয়তারা চলছিল। তিনি বিভিন্ন লোকজনের মাধ্যমে বুঝিয়ে রক্ষা পেয়েছেন।
রাজেন্দ্রপুর রেঞ্জের রাজেন্দ্রপুর পূর্ব বিটের কাফিলাতলী এলাকা দখলপ্রবণ। সেখানকার ইজ্জতপুর বাজারে থাকা বনভূমি দখল করে ৯টি নতুন দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। বাজারের আশপাশে বনভূমিতে করা হয়েছে প্রায় ৩০টি ঘর।
এ ছাড়া কাফিলাতলীতে বেশ কয়েকটি আকাশমনি প্লটের অন্তত সাত হাজার চারা তুলে বনভূমি দখলে নেওয়া হয়েছে। সুফল প্রকল্পের প্রায় তিন হাজার চারা তুলে সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে কয়েকটি বসতঘর।
খবর পেয়ে বিট অফিসের লোকজন ঘটনাস্থলে গেলে দুজনকে লাঞ্ছিত করা হয়। এরপর থেকে তারা প্রাণভয়ে নীরব রয়েছেন। দিন-রাত চলছে নতুন নতুন স্থাপনার কাজ।
একই রেঞ্জের মনিপুর বিটের কয়েকটি স্থানেও বনভূমিতে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। বিট অফিসের লোকজন নয়াপাড়া এলাকায় বাধা দিতে গিয়ে আক্রমণাত্মক অবস্থার মধ্যে পড়েন।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের মধ্যে বেশি দখল হচ্ছে ভাওয়াল রেঞ্জের ভবানীপুর বিটে। সেখানে বনভূমি দখল করে দিন-রাত নির্মাণ কাজ চলছে। কেউ কেউ বনভূমিতে ফাউন্ডেশন দিয়েও বাড়ি করছেন।
ঘটনার আড়ালের নিজস্ব প্রতিবেদক এ কে আজাদ সরেজমিনে গিয়ে দেখেছেন, বাঘের বাজার ঈদগাহ মাঠের পূর্ব পাশে, বাঘের বাজারের পশ্চিমে চায়না টিন কারখানার আশপাশে বনভূমিতে পাকা বাড়ি এবং মার্কেট নির্মাণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া ভবানীপুরের মুক্তিযোদ্ধা কলেজের পাশে, ফরিদ মার্কেট থেকে মনিপুর রাস্তার পূর্ব পাশে ও আকনপাড়ায় বনভূমি দখল এবং গাছপালা কেটে দিন-রাত বাড়িঘরের কাজ চলছে।
বিট অফিসের লোকজন একাধিক স্থানে বাধা দিতে গিয়ে আক্রমণাত্মক অবস্থার মধ্যে পড়েছেন। বিট কর্মকর্তা মিজানুর রহমান গত ২৫ আগস্ট জয়দেবপুর থানা পুলিশের সহযোগিতা চেয়ে আবেদন করেছেন। কিন্তু সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ৫ আগস্টের পর বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বনভূমিতে কমপক্ষে পাঁচ শতাধিক বাড়িঘর ও দোকানপাট করা হয়েছে। এর মধ্যে ভবানীপুর বিটে হয়েছে প্রায় ৪০০ স্থাপনা। দখল বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বারবার মাইকিং করলেও কাজ হচ্ছে না। গত ২৭ আগস্ট সেনাবাহিনী নিয়ে টহল দিয়েও দখলকারীদের ঠেকানো যায়নি।
কর্মকর্তারা বলছেন, সরকার পতনের পর প্রথম ১০-১৫ দিনে যে পরিমাণ বনভূমি দখল ও বনের ক্ষতিসাধন হয়েছে, গত ১০ বছরেও তা হয়নি। এখন শুধু মামলা দিলেই চলবে না। বনজ সম্পদ রক্ষা করতে হলে উচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপে প্রয়োজনে যৌথ বাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে সর্বত্র উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করতে হবে।
তবে এ-ও অভিযোগ উঠেছে, বনভূমি দখলের এই প্রেক্ষাপটে কতিপয় কর্মকর্তা ও কর্মচারী নীরবে বাণিজ্য করছেন। প্রথমত তারা সাধারণ দখলকারীদের মামলার হুমকি দিয়ে দালালদের মাধ্যমে টাকা নিচ্ছেন। দ্বিতীয়ত তাদের যোগসাজশে কিছু কিছু জায়গায় দখল বেশি হচ্ছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা হচ্ছে, শ্রীপুর রেঞ্জের সিংড়াতলী বিট অফিসের পাশে মাধখলা এলাকায় বনভূমিতে পাকা ও টিনশেড বাড়িঘর গড়ে উঠছে। বিট অফিসের লোকজন সেখানে গেলেও হামলা বা আক্রমণাত্মক অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। বিট অফিসে লেনদেন করে কাজ হওয়ার কথা এখন ওপেন সিক্রেট।