গাজীপুরে ‘জাহাঙ্গীরের ভোট ব্যাংক’ দিয়ে মন্ত্রী-এমপিদের হারাতে লড়াই
ঘটনার আড়ালে প্রতিবেদন : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে গাজীপুরে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চলছে। কয়েকজন প্রার্থী একে অপরকে লক্ষ্য করে কথার ঢিল ছুড়ছেন। বিভিন্ন প্রতিশ্রম্নতির পাশাপাশি ব্যক্তিগত আক্রমণেও জড়াচ্ছেন তারা।
যদিও প্রার্থীরা রাজনৈতিক পরিবারে একই ঘরের সন্তান। মূলত প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচন বয়কট করায় তারা নির্বিঘ্নে স্বতন্ত্র তথা বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এখন সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে চলছে এমপি পদে জেতার লড়াই।
জেলার পাঁচটি সংসদীয় আসনের মধ্যে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের অংশ নিয়ে তিনটি আসন গঠিত। সিটির অধিকাংশ নিয়ে গাজীপুর-২ আসন। এখানে নৌকা প্রতীকের মনোনয়ন পেয়েছেন টঙ্গী এলাকার বাসিন্দা বর্তমান যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল।
তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আছেন গাজীপুর শহরের উত্তর ছায়াবিথী এলাকার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী আলিম উদ্দিন বুদ্দিন। তিনি মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি।
গাজীপুর-১ আসন কালিয়াকৈর উপজেলা ও গাজীপুর মহানগরীর বাসন, কোনাবাড়ী এবং কাশিমপুর থানা এলাকা নিয়ে গঠিত। আসনটিতে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন গাজীপুর শহরের বাসিন্দা বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।
তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আছেন কালিয়াকৈর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম রাসেল। তিনি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। তার বাবা প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী ছামান উদ্দিন আহম্মেদ ছিলেন চাপাইর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান।
গাজীপুর-৫ আসন কালীগঞ্জ উপজেলা এবং গাজীপুর সদর উপজেলার বাড়ীয়া ইউনিয়ন ও সিটি করপোরেশনের পূবাইল থানা এলাকা নিয়ে গঠিত। এখানে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য এবং সাবেক শিশু ও মহিলা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি।
এই তিনটি আসন সিটি করপোরেশন কেন্দ্রিক হওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন সাবেক সিটি মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম। তিনি গত সিটি নির্বাচনে প্রার্থিতা না পাওয়ায় তার মা জায়েদা খাতুনকে নিয়ে মাঠে নেমে বিজয়ী হন। জাহাঙ্গীর আলম বর্তমানে মেয়রের উপদেষ্টা হিসেবে আছেন।
জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে জাহিদ আহসান রাসেল ও আ ক ম মোজাম্মেল হকের বিরোধ প্রকাশ্য। আর আখতারউজ্জামানের সঙ্গে জাহাঙ্গীর আলমের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। দ্বন্দ্ব সমীকরণে কাজী আলিম উদ্দিন বুদ্দিন ও রেজাউল করিম রাসেল প্রত্যক্ষভাবে জাহাঙ্গীর আলমের সমর্থন এবং সহযোগিতা পাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকেও এই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ছবির সঙ্গে জাহাঙ্গীর আলমের ছবি সংবলিত পোস্টার ছড়িয়ে পড়েছে।
বিশেষ করে কাজী আলিম উদ্দিন বুদ্দিনের নির্বাচনী কার্যক্রমে জাহাঙ্গীর আলম সরাসরি মাঠে নেমেছেন। তিনি জাহিদ আহসান রাসেলকে উদ্দেশ্য করে ঝাঁজালো বক্তব্যও দিচ্ছেন।
সম্প্রতি নগরীর বঙ্গতাজ অডিটরিয়ামে জাহাঙ্গীর আলমের উপস্থিতিতে এক মতবিনিময় সভায় কাজী আলিম উদ্দিন বুদ্দিন বলেছেন, আমি যদি নির্বাচিত হই, সে বিজয় হবে জাহাঙ্গীরের। আমি বিজয়ী হলে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সমন্বয় করে একটি সুন্দর গাজীপুর গড়ে তুলব।
তিনি আরও বলেছেন, সারা বাংলাদেশে জাহাঙ্গীর আলমের মত নেতা খুব বিরল। সে একজন ক্যারিশম্যাটিক নেতা। মাত্র তিন বছরে গাজীপুরের চেহারা পরিবর্তন করে দিয়েছিল। তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছিল। সেসহ সবাই আমার পক্ষে রয়েছে।
এ সময় জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, একটি পরিবর্তন দরকার। এই পরিবর্তন বুদ্দিন ভাইয়ের মাধ্যমে যেন হয়। রাজনীতিতে দেখেছি বুদ্দিন ভাই একজন আদর্শবান মানুষ। তাই আমরা বুদ্দিন ভাইয়ের জন্য ভোট চাই।
নগরীর গাছা থানার হাজীর পুকুর বালুর মাঠ এলাকায় গত ১৬ ডিসেম্বর ইমাম-খতিব ও ওলামা-মাশায়েখ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। তার আমন্ত্রণে অনুষ্ঠানে কাজী আলিম উদ্দিন বুদ্দিন ও রেজাউল করিম রাসেল উপস্থিত ছিলেন। এ সময় জাহাঙ্গীর আলম ৫৭টি ওয়ার্ডের মসজিদগুলোর ২৬ হাজার ইমাম-খতিবকে মাসে তিন হাজার টাকা করে সম্মানী ভাতা দেওয়ার ঘোষণা দেন।
গত ১৮ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দের পর কাজী আলিম উদ্দিন বুদ্দিন, রেজাউল করিম রাসেল ও আখতারউজ্জামানকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ীয়া ইউনিয়নের একটি রিসোর্টে বিজয় দিবসের আলোচনা সভায় যোগ দেন জাহাঙ্গীর আলম। এ সময় তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটা সুযোগ দিয়েছেন। সেই সুযোগ আগামী ৭ জানুয়ারি আমরা কাজে লাগাতে চাই। আমাদের আদর্শের ভাই আখতারউজ্জামান। তার নীতির সঙ্গে আমরা আছি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওই তিন প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমের বড় ভোট ব্যাংকের সুবিধা পেতে তার সহযোগিতা নিচ্ছেন। তাদের পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ নিলে জাহাঙ্গীর আলমেরও এক ঢিলে দুই পাখি শিকারের মত মধুর প্রতিশোধ নেওয়া হবে।
তবে হেভিওয়েট প্রার্থী জাহিদ আহসান রাসেল, আ ক ম মোজাম্মেল হক এবং মেহের আফরোজ চুমকি বিজয়ী হতে জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের বিষয় তুলে ধরে জনগণের কাছে ভোট প্রার্থনা করছেন। দলীয় নেতা-কর্মীরা ভোটাভুটি নিয়ে বিভক্ত হলেও নেতৃস্থানীয় অনেকে তাদের পক্ষে রয়েছেন।
টঙ্গীর মুদাফা এলাকার কাউন্সিলরের বাসায় গত ১৫ ডিসেম্বর জাহিদ আহসান রাসেলের সমর্থনে উঠান বৈঠক হয়। এতে জাহাঙ্গীর আলমের উদ্দেশে প্রতিমন্ত্রীর স্ত্রী খাদিজা রাসেল বলেন, জাহাঙ্গীর সাহেব আগে নিজের ঘর ঠিক করেন। আমার সন্তান নাই, এই কথা বলেছেন। আপনার তো সন্তান আছে, কিন্তু সন্তানের মা কোথায়?
তিনি ভোটারদের উদ্দেশে বলেন, রাসেল তার বাবার আদর্শে বড় হয়েছেন। তিনি তার বাবার মতই মানুষের সেবা করছেন। তার স্বামী একজন আদর্শ মানুষ।