গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর পূর্ব বিটে রাস্তাকে ইস্যু করে দখল বাণিজ্য চাপা!
ঘটনার আড়ালে প্রতিবেদন : গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর রেঞ্জের রাজেন্দ্রপুর পূর্ব বিটে সংঘটিত বনভূমি দখল ও আটক বাণিজ্য চাপা পড়ে যাচ্ছে।
একটি রাস্তাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উত্তেজনার প্রেক্ষিতে অপরাধগুলো এড়িয়ে যাওয়ার তৎপরতায় বেহাত হচ্ছে মূল্যবান বনভূমি। দায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
ফাওগান রোডের পূর্ব পাশে ঘন গজারি বনের ভেতর দিয়ে নিশ্চিন্তপুর টেকপাড়া পোলট্রি রাস্তা। পায়ে হাঁটার এই পথ বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারের কার্যক্রম চালাচ্ছে ‘গ্রে ডি স্টুডিও’ নামের একটি নির্মাণাধীন রিসোর্ট।
রিসোর্টের ঢাকাস্থ মালিক পক্ষ স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে রাস্তাটি ইটের সলিং করার চুক্তি করেন। পরে গত সেপ্টেম্বরে রাস্তায় বালু ফেলে ইট বসানোর কাজ শুরু হয়।
এক পর্যায়ে ঘটনাটি জানাজানি হলে রাস্তা বন্ধের নামে ৭০০-৮০০ ফুট দৈর্ঘ্য অংশে আকাশমনি চারা রোপণ করে বিট অফিস। তবে গাড়ি চলাচলের জন্য মাঝখানে ৮-১০ ফুট করে ফাঁকা রাখা হয়।
বিষয়টির ওপর গত ১৯ সেপ্টেম্বর সাপ্তাহিক ঘটনার আড়ালের অনলাইন সংস্করণে একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে চলে তোলপাড়। পরদিন সকালে ঢাকা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) এস এম সাজজাদ হোসেনের নির্দেশে ফাঁকা অংশসমূহে চারা রোপণ করা হয়।
আরও পড়ুন : গাজীপুরে ডিমারকেশন ছাড়াই কারখানার গোডাউন, বন দিয়ে রিসোর্টের রাস্তা!
এর কয়েক দিন পর দুষ্কৃতিকারীরা স্থানীয় লোকদের উসকানি দিয়ে চারাগুলো তুলে ফেলে। পরে রাস্তার কিছু কিছু অংশ কেটে দিয়ে আবার কিছু চারা রোপণ করা হয়। একই সঙ্গে দুজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন বিট কর্মকর্তা কে বি এম ফেরদৌস।
এরপর লোকজন গাজীপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেন সবুজের শরণাপন্ন হন। এমপি গত ১১ অক্টোবর ঘটনাস্থলে গেলে লোকজন তার উপস্থিতিতে রাস্তার মুখে থাকা বাঁশের বেড়া ভেঙে সকল চারা তুলে ফেলেন। এ ঘটনায় বন কর্মকর্তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রাস্তার অপর প্রান্তে ওই রিসোর্টের নির্মাণ কাজ সাবেক বিট কর্মকর্তা আইয়ুব খানের আমলে শুরু হয়েছে। রিসোর্ট ঘেঁষে বন থাকলেও যৌথ ডিমারকেশন করা হয়নি। স্থানীয়ভাবে রিসোর্টটি দেখাশোনা করছেন জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা নূরুল ইসলাম শিমুল।
গ্রে ডি রিসোর্ট ডিমারকেশন ছাড়াই নির্মাণ কাজ শুরু করলেও আইয়ুব খান কোন বাধা দেননি। তিনি গত ফেব্রুয়ারিতে শ্রীপুর রেঞ্জের সাতখামাইর বিটে বদলি হয়ে যাওয়ার পর বর্তমান বিট কর্মকর্তাও ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন। বিনিময়ে লেনদেন হয় চুক্তির প্রথম কিস্তির এক লাখ টাকা।
ওই রাস্তায় চার-পাঁচ দিন ধরে ইট-বালু ফেলা হলেও বিট কর্মকর্তা সম্পূর্ণ নীরব থাকেন। শেষে ওপর মহলে অভিযোগ গেলে তিনি তৎপরতা দেখান।
সংশ্লিষ্ট কয়েকজন বলেন, বিট কর্মকর্তা ঘুষ না নিয়ে রিসোর্টের ব্যাপারে প্রথম থেকেই ব্যবস্থা নিলে ঘটনা এত দূর গড়াত না। যে নেতার উসকানিতে লোকজন চারা তুলে ফেলেছেন ও রাস্তার দাবি নিয়ে এমপি পর্যন্ত গিয়েছেন, মামলায় তাকে আসামি করা হয়নি।
এদিকে ইজ্জতপুর কবরস্থানের পাশে কাফিলাতলী মৌজার সিএস ৫৮ নং দাগের প্রায় পাঁচ গন্ডা সংরক্ষিত বনভূমি দখল করে বারান্দাসহ পাকা তিন রুমের বাড়ি করেছেন ফল ব্যবসায়ী কদম আলী। গত রমজানের মাঝামাঝি সময়ে বাড়িটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়।
বনভূমিতে কদম আলীর নবনির্মিত বাড়ি
বিট অফিস প্রথমে দুই দফায় ৮০ হাজার টাকা নিয়েছে বলে অভিযোগ। পরে ঘটনার আড়ালে-তে প্রতিবেদন প্রকাশের পর স্থাপনা না ভাঙা ও মামলা না দেওয়ার কথা বলে আরও টাকা নেওয়া হয়েছে।
দখলীয় দাগ পার্ট না থাকলেও খোদ রেঞ্জ কর্মকর্তা জুয়েল রানা আরএস রেকর্ডমূলে জমি কদম আলীকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। তিনি সার্ভেয়ার নিয়ে একবার মাপজোখও করেছেন।
ইজ্জতপুর রেলক্রসিংয়ের পশ্চিম পাশে সুফল প্রকল্পের চারা তুলে প্রায় পাঁচ গন্ডা জমি দখল করেন সিরাজুল ইসলাম। পরে রঙিন টিন ও লোহার অ্যাঙ্গেল দিয়ে তিন রুমের বাড়ি নির্মাণ করা হয়।
গত ১২ সেপ্টেম্বর ঘটনার আড়ালে-তে দ্বিতীয় প্রতিবেদন প্রকাশের পর রেঞ্জ কর্মকর্তার উপস্থিতিতে সিরাজুলের বাড়ির কিছু টিন ও চারপাশের টিনের বেড়া খুলে রাখা হয়। কাটার মেশিন দিয়ে কেটে দেওয়া হয় চালার দুটি লোহার অ্যাঙ্গেল। কয়েক দিন পর আবার বেড়া দিয়ে বাড়ি মেরামত শুরু হয়েছে।
ওয়াকিবহাল সূত্র জানায়, সিরাজুল প্রথমে কাজ শুরু করলে রোজার ঈদের দুদিন পর বিট অফিসের লোকজন গিয়ে ভেঙে দেন। পরে দুই দফায় ৮০ হাজার টাকা নিয়ে গত জুনে আবার কাজের অনুমতি দেওয়া হয়।
ইজ্জতপুর স্কুলের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ডিমারকেশন ছাড়াই ব্লক ইট তৈরির কারখানা স্থাপন করছেন ঢাকার শাহাদাত হোসেন। বৃহৎ প্রজেক্টটির তিন পাশে বনভূমি। সেখানে মালবাহী গাড়ি চলাচলের জন্য বনভূমি দখল করে ১২০ ফুট দৈর্ঘ্যের রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। বিট অফিস তার কাছ থেকে এক লাখ ১০ হাজার টাকা নিয়েছে বলে অভিযোগ।
ঘটনার আড়ালে-তে প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিট অফিস মাপজোখ করে বনের অংশে চারা রোপণ করেছিল। কয়েক দিন পর চারাগুলো তুলে ফেলা হয়। এ ঘটনায় মামলা না দিয়ে আরও টাকা নেওয়া হয়েছে।
ইজ্জতপুর বাজারের পূর্ব পাশে প্রায় ২০ শতাংশ বনভূমি দখল করে চার রুমের মাটির বাড়ি নির্মাণ করেন সাইদুল ইসলাম। তার কাছ থেকে মামুন নামের একজন ১০ লাখ টাকায় সব কিনে নেন।
পরে মামুন আরসিসি খুঁটি পুঁতে রঙিন টিন দিয়ে বাউন্ডারি ও বারান্দা নির্মাণ করেন। একই সঙ্গে ‘ভান্ডারী খানকা শরীফ’ করার জন্য রুমগুলোর ভিটি পাকা করে টাইলস স্থাপন ও রাজকীয় গেট নির্মাণের কাজ শুরু হয়।
বিল্লাল মাস্তান নামের এক দালাল মামুনকে বাড়ি কেনাসহ সার্বিক সহযোগিতা করেন। বাড়িটির পূর্ব পাশ থেকে কিছু আকাশমনি, মেহগনি ও গজারি গাছ কেটে বিক্রি করা হয়। এই স্পট থেকে বিট অফিস এক লাখ টাকা নিয়েছে বলে অভিযোগ।
ঘটনার আড়ালে-তে প্রতিবেদন প্রকাশের পর নবনির্মিত টিনের বাউন্ডারি, বারান্দা ও গেটের পিলার ভেঙে দেওয়া হয়। জব্দ করে অফিসে নেওয়া হয় কিছু মালামাল। পরে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা না দিয়ে আরও এক লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ।
বিট অফিসের দক্ষিণ পাশের খেলার মাঠের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে ফাউন্ডেশন দিয়ে বাড়ি নির্মাণ করছেন আলী হোসেন। বাড়িটির সামনের অংশে প্রায় এক শতাংশ বন দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। তার ডিমারকেশনও নেই। ঘটনার আড়ালের প্রতিবেদনে তা তুলে ধরা হলেও অদ্যাবধি কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
বন দখল করে আলী হোসেনের স্থাপনা
গত ১৪ আগস্ট সন্ধ্যায় ইজ্জতপুর রোড থেকে পিকআপ বোঝাই আকাশমনি গাছসহ দুজনকে আটক করেন বিট কর্মকর্তা ও বনপ্রহরী ফিরোজ শেখ। গাছগুলো নলজানি এলাকার ব্যবসায়ী এনায়েত হোসেন ওরফে ইছুর। পরে রাতে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে আটককৃতরা ছাড়া পান।
এ ঘটনায় পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার দেখিয়ে একটি ইউডিআর মামলা করা হয়। গত ২০ অক্টোবর সন্ধ্যায় ওই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে গাড়ি ছাড়া বাবদ রাজস্বসহ ৬০ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ।
এ ছাড়া আটক ও দখল বাণিজ্যের আরও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। এত কিছুর পরও কতৃর্পক্ষ দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় জনমনে নানা প্রশ্ন ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
একজন বন কর্মকর্তা বলেন, বনভূমি দখলের সঙ্গে কর্মকর্তারা জড়িত থাকলে স্থাপনা উচ্ছেদ করা কঠিন। কারণ যারা টাকা দিয়ে সুবিধা নেন, ভাঙতে গেলে তারা বাধা দেবেন-এটা স্বাভাবিক। রাজেন্দ্রপুর পূর্ব বিটে যে অবস্থা চলছে, তা থেকে উত্তরণে বিতর্কিতদের প্রত্যাহার করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
অপরদিকে ঘটনার আড়ালে-তে বন বিভাগের পক্ষে পজিটিভ নিউজ কম হয় বলে সম্পাদককে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন রাজেন্দ্রপুর ও শ্রীপুর রেঞ্জের দায়িত্বে থাকা সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) শামসুল আরেফীন।
এ প্রসঙ্গে পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, বন রক্ষার উদ্দেশে যে নিউজ প্রকাশিত হয়, সেটাই হচ্ছে প্রকৃত নিউজ। কারণ এ ধরনের নিউজের মাধ্যমে বাস্তব তথ্য পেয়ে বন বিভাগ ব্যবস্থা নিতে পারে। ব্যক্তির স্বার্থে মূল ঘটনা এড়িয়ে যাওয়া নিউজে বনের কল্যাণ হয় না। তবে কর্মকর্তারা ভালো কিছু করলে সেটা তুলে ধরা উচিত। ঘটনার আড়ালে-তে ফলোআপ দেখা যায়।
আরও পড়ুন : গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর পূর্ব বিটে ‘বন দখল ও আটক বাণিজ্য’ জমজমাট