গাজীপুরের মনিপুর বিটে দেদারসে বনভূমি দখল, হচ্ছে না উচ্ছেদ

ঘটনার আড়ালে প্রতিবেদন : গাজীপুরের মনিপুর বিটে মূল্যবান বনভূমি দখল করে বাড়িঘর ও দোকানপাট গড়ে উঠছে। লেনদেন হচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
ঢাকা বন বিভাগের রাজেন্দ্রপুর রেঞ্জের এই বিটে উচ্ছেদ ও বনায়নে জোর না দেওয়ায় বাড়ছে অসাধু চক্রের দৌরাত্ম্য। মাঝে-মধ্যে মামলা দিয়ে এড়ানো হচ্ছে দায়।
সরেজমিনে জানা যায়, মনিপুর খাসপাড়া পুরাতন মসজিদের পূর্ব-দক্ষিণ পাশে পাঁচ তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে বাড়ি নির্মাণ করছেন হাসিনা আক্তার। সেখানে যাতায়াতের রাস্তাসহ সামনের অংশ সংরক্ষিত বনভূমি। তার সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত ডিমারকেশনও নেই।
সাবেক রেঞ্জ কর্মকর্তা সৈয়দ আমিনুর রহমানের আমলে হাসিনা আক্তারের বাড়ির কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এরপর তিনি ডিমারকেশনের জন্য আবেদন করলেও তা এখনো অনুমোদন হয়নি।
এরই মধ্যে হাসিনা আক্তার আবারও নির্মাণ কাজ শুরু করেছেন। ইতিমধ্যে নিচ তলার ছাদ ঢালাই সম্পন্ন হয়েছে। বিট অফিস কোন ব্যবস্থা নেয়নি।
কিছুদিন আগে বর্তমান রেঞ্জ কর্মকর্তা জুয়েল রানা খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে কাজ বন্ধ করে দেন। কিন্তু বিট অফিস সুযোগ দেওয়ায় কাজ ফের শুরু হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রেঞ্জ কর্মকর্তার নির্দেশে ওই স্থানে প্রাথমিক মাপজোখ করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, হাসিনা আক্তারের বাড়ির উত্তর দিক দিয়ে সামনের অংশের তিনটি পিলার ও সিঁড়ির অংশ বনে পড়েছে। তবে স্থাপনা উচ্ছেদে কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
বিট অফিসের কাছে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক সংলগ্ন বেগমপুর হোতাপাড়া এলাকার সিএস ৫৯৮ নং দাগের জমি বন বিভাগের নামে গেজেটভুক্ত। এই পার্ট দাগে ডিমারকেশন ছাড়াই ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে।

বেলায়েত ডাক্তারের নবনির্মিত মার্কেট


ইএসবিএল গার্মেন্টসের দক্ষিণ পাশে স্থানীয় বেলায়েত হোসেন ওরফে বেলায়েত ডাক্তার সম্প্রতি নতুন মার্কেট নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন। মার্কেটের পেছনের অংশে গোডাউন। তিনি আগেও ফাউন্ডেশন দিয়ে বাড়ি করেছেন। বিট অফিস কখনো কোন ব্যবস্থা নেয়নি।
নৌলাপাড়া এলাকার মোজাফফর হাজির বাড়ির পশ্চিম পাশে কয়েক মাস আগে প্রায় পাঁচ গন্ডা বনভূমি কিনে টিনশেড বাড়ি করেছেন আকরাম হোসেন। তার বাড়ির পূর্ব পাশে বনভূমি দখল করে তিন রুমের টিনশেড বাড়ি করেছেন কবির।
কাতলামারা দিঘির দক্ষিণ পাশে প্রায় পাঁচ গন্ডা বনভূমি কিনে তাতে বাড়ি করে মেয়েকে দিয়েছেন জসিম সরকার। তার বাড়ির দক্ষিণে আকাশমনি বাগানের ভেতরে থাকা বনভূমি কিনে টিনশেড বাড়ি করেছেন মালেক।

কাতলামারা পশ্চিমপাড়ার ইদম আলীর বাড়ির পূর্ব পাশে পাঁচ গন্ডা বনভূমি কিনে বারান্দাসহ তিন রুমের পাকা বাড়ি করেছেন সিরাজগঞ্জের হামিদুল। বাড়িটি লতিফ নামের একজনের কাছে ভাড়া দেওয়া। এই বাড়ির পূর্ব পাশে বনভূমিতে হামিদুলের আরেকটি বাড়ি আছে।
বেগমপুর এলাকার মাহবুবের বাড়ির পাশে বনভূমি দখল করে তিন রুমের টিনশেড বাড়ি করেছেন হুমায়ুন। বেগমপুর আইডিয়াল স্কুলের পশ্চিম পাশে বনভূমি দখল করে দুই রুমের পাকা বাড়ি করেছেন ইমন।
নয়াপাড়া এলাকার কুষ্টিয়া মার্কেটের উত্তর পাশে বনভূমি দখল করে তিন-চার মাস আগে তিন রুমের টিনশেড বাড়ি করেছেন মনসুরের মেয়ের জামাই। এখন চলছে ইটের গাঁথুনি দিয়ে বারান্দার কাজ।
পূর্ব নয়াপাড়ার মন্দিরের পাশে বনভূমি দখল করে বারান্দাসহ তিন রুমের বাড়ি করেছেন রঞ্জিত। কাজ শুরু হলে বিট অফিসের লোকজন প্রথমে ভেঙে দেন। পরে লেনদেন করে কাজ সম্পন্ন করা হয়।
দক্ষিণ নয়াপাড়ার বালুর মাঠের উত্তর পাশে ডিমারকেশন ছাড়াই দোতলা ফাউন্ডেশন দিয়ে বাড়ি করেছেন নোয়াখালীর রুহুল আমিন। সেখানে বনভূমিতে তার আরেকটি বাড়ি আছে। তিনি বন মামলারও আসামি।
নয়াপাড়ার কেমিকন কারখানার পূর্ব পাশে প্রায় ১০ শতাংশ বনভূমি দখল করে দোকান করেছেন আবু তালেব। তিনি সেখানে মেসার্স রীমা এন্টারপ্রাইজ নামে রড-সিমেন্ট ও ইট-বালুর ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে পূর্বের একটি বন মামলা থাকলেও বিট অফিসের সঙ্গে বেশ সখ্যতা রয়েছে।
মনিপুর-জয়নাতলী রাস্তার পেয়ারা বাগানের পাশে বনভূমি দখল করে তিন রুমের বাড়ি করেছেন সিরাজ। কাজ শুরু হলে বিট অফিসের লোকজন প্রথমে ভেঙে দেন। পরে লেনদেন করে কাজ সম্পন্ন করা হয়।
মনিপুর খাসপাড়া এলাকায় বনভূমি দখল করে একটি বাড়ি করেন লালু। পরে তিনি বাড়িটি প্রায় আট লাখ টাকায় আলাউদ্দিনের কাছে বিক্রি করে দেন। আলাউদ্দিন দখল বুঝে নিয়ে রাস্তার পাশে তিনটি টিনশেড দোকান করে ভাড়া দিয়েছেন।
মনিপুর খাসপাড়ায় বনভূমি দখল করে সম্প্রতি একটি দোকান করেছেন সেকান্দার। আগেও তার জবর দখল রয়েছে।
উল্লেখ্য, দখলপ্রবণ এই বিটে তিন মাস ধরে বিট কর্মকর্তা নেই। বিট কর্মকর্তা এমরান হোসেন গত সেপ্টেম্বরে বদলি হয়ে যাওয়ার পর থেকে সালনা বিট কর্মকর্তা মুস্তানুর রহমান চৌধুরী মনিপুর বিটের অতিরিক্ত দায়িত্বে আছেন।
বিটটিতে বিভিন্ন সময়ে দখল বাণিজ্যের ঘটনা নিয়ে আলোকিত নিউজ ডটকমে বেশ কয়েকটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সেসবের তদন্ত হলেও দায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
কিছু কিছু স্থাপনা ভাঙচুর করা হলেও সম্পূর্ণ উচ্ছেদ ও বনায়ন কার্যক্রমে জোর দেয়নি কর্তৃপক্ষ। ফলে ভাঙচুরকৃত স্থাপনাগুলোর নির্মাণ কাজ আবার শুরু হয়।
মনিপুর বিটের বাগান মালি আমির হোসেনকে প্রায় এক বছর আগে কালিয়াকৈর রেঞ্জের সাভার বিটে বদলির আদেশ হয়েছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তাকে রিলিজ দেওয়া হচ্ছে না। সুযোগ পেয়ে পুরনো স্টাফ হিসেবে তিনি বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।
এ ব্যাপারে রাজেন্দ্রপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা জুয়েল রানা ঘটনার আড়ালে-কে বলেন, তিনি যেখানে অভিযোগ পাচ্ছেন, সেখানে ব্যবস্থা নিচ্ছেন। তার জানামতে হাসিনা আক্তারের বাড়ির কাজ বন্ধ আছে। যেসব স্থাপনা হয়ে গেছে, সেসব বিষয়ে উচ্ছেদ প্রস্তাবসহ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
একজন বন কর্মকর্তা বলেছেন, বনভূমি রক্ষা করতে হলে দখলের খবর পাওয়ামাত্র নিজেদের সক্ষমতা অনুযায়ী সমন্বিতভাবে প্রতিরোধ ও উচ্ছেদ করতে হবে। স্থাপনা নির্মাণের পর জেলা প্রশাসনে উচ্ছেদ প্রস্তাব দিয়ে তেমন ফল পাওয়া যায় না। এ ধরনের শত শত প্রস্তাব ২০০৭ সাল থেকে পড়ে আছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button