গাজীপুরে ‘নিষিদ্ধ মৌজায়’ মাদবর এগ্রোর দূষণের দাপট, ডিডি নয়নের কারসাজিতে ছাড়পত্র!
ঘটনার আড়ালে প্রতিবেদন : গাজীপুরে নিষিদ্ধ মৌজায় কারখানা স্থাপন করে দেদারসে উৎপাদন কার্যক্রম চালাচ্ছে মাদবর এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। একই সঙ্গে চলছে ব্যাপক দূষণ।
বিষয়টি নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক নয়ন মিয়া প্রথমে কিছু তৎপরতা দেখালেও শেষে চুপসে যান। তিনি প্রতিষ্ঠানটিকে গোপনে সহযোগিতা করছেন বলে অভিযোগ।
সরেজমিনে জানা যায়, মৎস্য ও প্রাণিখাদ্য উৎপাদনকারী মাদবর এগ্রো সদর উপজেলার ভাওয়ালগড় ইউনিয়নের নলজানী গ্রামে গড়ে উঠেছে। কারখানাটির মালিক আওলাদ হোসেন মাদবর। গত পাঁচ বছর ধরে এর উৎপাদন ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম চলছে।
কারখানা সংলগ্ন উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ পাশে বসতবাড়ি। তিন পাশে সংরক্ষিত বনভূমি। পশ্চিম পাশে নলজানী মোজাদ্দেদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। কারখানা থেকে বিদ্যালয়টির দূরত্ব ১০০ মিটার।
কারখানাটিতে দিন-রাত উৎপাদন চলে। শব্দ দূষণ অসহনীয়। পাউডার-জাতীয় ডাস্ট উড়ে ঘরের ভেতরে যায়। নষ্ট হয় খাবার ও কাপড়-চোপড়। ডাস্ট জমে ঘরের চালার টিনও নষ্ট হচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, কারখানার দূষণে তারা অতিষ্ঠ। মালিককে বারবার জানালেও কোন প্রতিকার হয়নি। উল্টো হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে। দূষণের কারণে ফলমূলের উৎপাদনও কমছে।
স্কুলে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটিতে ১২৬ জন শিশু শিক্ষার্থী রয়েছে। কারখানার দুর্গন্ধে পাঠদানে সমস্যা হচ্ছে। কোন কোন শিক্ষার্থী বমিও করে।
এই অবস্থায় জেলা পরিবেশ কার্যালয় একাধিকবার সরেজমিনে তদন্ত করে অভিযোগগুলোর সত্যতা পায়। প্রথমে ২০২১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর পরিবেশ অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতিসাধন করার দায়ে কারখানাটিকে দুই লাখ পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করেন। একই সঙ্গে কারখানার অবস্থান গ্রহণযোগ্য হলে এক মাসের মধ্যে দূষণ নিয়ন্ত্রণপূর্বক পরিবেশগত ছাড়পত্র গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়।
কিন্তু মাদবর এগ্রোর মালিক পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশনার কোন তোয়াক্কা করেননি। তিনি ধার্যকৃত সময়ের মধ্যে ছাড়পত্র গ্রহণ না করেই উৎপাদন কার্যক্রম পুরোদমে অব্যাহত রাখেন।
পরে ওই বছরের ৩১ অক্টোবর কারখানার কার্যক্রম সরেজমিনে পরিদর্শন করে ১ নভেম্বর মালিককে নোটিশ দেন জেলা পরিবেশ কার্যালয়ের উপ-পরিচালক নয়ন মিয়া। এতে বলা হয়, কারখানাটির অবস্থান নিষিদ্ধ মৌজায় এবং দৃশ্যত অগ্রহণযোগ্য এলাকায়। কারখানার ১০০ মিটারের মধ্যে বসতবাড়ি, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ ও বন অবস্থিত। কারখানা কতৃর্ক সৃষ্ট উচ্চ শব্দ, ডাস্ট ও দুর্গন্ধ দ্বারা এলাকাটিতে বসবাসের স্বাভাবিক পরিবেশ বিনষ্ট এবং পরিবেশ-প্রতিবেশ ব্যবস্থার মারাত্মক ক্ষতিসাধন করা হচ্ছে।
নোটিশে আরও বলা হয়, আইন ও বিধির আলোকে পরিবেশগত ছাড়পত্র না পাওয়া পর্যন্ত কারখানাটির সকল উৎপাদন ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম বন্ধ রাখার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হল। ব্যত্যয়ে পরিবেশ আইন ও বিধি অনুসারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এই নোটিশের পরও মালিক দূষণ বন্ধে কোন উদ্যোগ নেননি। এক দিনের জন্যও বন্ধ করেননি উৎপাদন কার্যক্রম। পূর্ব ও দক্ষিণ দিক দিয়ে কারখানা সম্প্রসারণের কার্যক্রমও অব্যাহত থাকে।
এভাবে চলে গেছে আড়াই বছর। কারখানাটির দূষণ এখনো বন্ধ হয়নি। মালিককে আইন মানাতে পারেনি পরিবেশ অধিদপ্তর। এই দীর্ঘ সময়ে অবস্থানগত ছাড়পত্র ছাড়াই বেড়েছে কারখানার আয়তন।
জেলা পরিবেশ কার্যালয়ের উপ-পরিচালক নয়ন মিয়া
ওয়াকিবহাল সূত্র জানায়, মাদবর এগ্রোর মালিক জেলা পরিবেশ কার্যালয়ের ডিডি নয়ন মিয়াসহ একাধিক কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে ২০২২ সালের এপ্রিলে পরিবেশগত ছাড়পত্র বাগিয়ে নিয়েছেন। ঘুষের ম্যাজিকে নিষিদ্ধ মৌজা তাদের কাছে এখন বিশুদ্ধ। জনস্বার্থ দেখার যেন কেউ নেই।
সূত্র আরও জানায়, মাদবর এগ্রোর মালিক স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও স্ট্যাম্পে অনাপত্তি সংক্রান্ত লিখিত নিয়েছেন। বিনিময়ে স্কুলের টয়লেট নির্মাণ ও ডোনেশন দিয়েছেন।
স্কুলটির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম ঘটনার আড়ালের কাছে বিষয়টি স্বীকারও করেছেন। তিনি বলেন, কারখানার কারণে এখন সমস্যা হয় না। মালিক এক-দেড় লাখ টাকা দিয়ে টয়লেট নির্মাণ করে দিয়েছেন।
এদিকে বারবার চেষ্টা করেও কোন প্রতিকার না পেয়ে প্রতিবাদকারীরা হতাশ হয়ে অনেকটা থমকে গেছেন। জেলা পরিবেশ কার্যালয়ের ডিডি নয়ন মিয়াকে ফোন করলে তিনি এখনো ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন। কিন্তু বাস্তবে কিছুই হচ্ছে না।
ভুক্তভোগী একজনের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরেজমিনে তদন্ত করে গত ২ জানুয়ারি মাদবর এগ্রোর মালিককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন ডিডি নয়ন মিয়া। এবারও গুরুতর তথ্য ওঠে আসে।
নোটিশে বলা হয়, কারখানাটিতে উৎপন্ন পশুখাদ্য, মৎস্যখাদ্য ও পোলট্রির খাদ্যের দুর্গন্ধ এবং শব্দ দূষণ পরিলক্ষিত হয়েছে। সাউন্ড মিটার ব্যবহার করে শব্দের মাত্রা আবাসিক এলাকা হিসেবে গ্রহণযোগ্য মানমাত্রার বাইরে ৮০ ডেসিবেল পাওয়া গেছে। যা শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন এবং পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ও দণ্ডনীয় অপরাধ।
শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ২০০৬ অনুসারে আবাসিক এলাকায় দিনের বেলা শব্দের সর্বোচ্চ মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল। কারখানার কার্যক্রমের ফলে চারদিকে মারাত্মক দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে এবং পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থার মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। যা পরিবেশগত ছাড়পত্রের ৪ ও ২৭ নং শর্তের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
নোটিশে মালিককে দুর্গন্ধ ও শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়। অন্যথায় পরিবেশগত ছাড়পত্র বাতিলসহ ক্ষতিপূরণ আরোপ ও মামলা দায়েরের হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।
সর্বশেষ এই নোটিশ জারির পর চার মাস পার হয়েছে। মালিক এই সময়ের মধ্যে দুর্গন্ধ ও শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে কোন ব্যবস্থা নেননি। ডিডি নয়ন মিয়াও আর কিছুই করেননি।
অভিযোগ রয়েছে, মাদবর এগ্রোর ব্যাপারে ডিডি নয়ন মিয়া প্রথমে গরম ছিলেন। পরে লেনদেনে সন্তুষ্ট হয়ে তিনি পরিবেশগত ছাড়পত্রের জন্য পক্ষে প্রতিবেদন দেন। এখন অভিযোগ পেলে নোটিশ দিয়ে সুবিধা নেওয়া হয়।
এ ব্যাপারে মাদবর এগ্রোর মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করলে কামরুল হাসান নামের এক কর্মকর্তা ফোন ধরেন। তিনি আরেক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেবেন বললেও পরে আর সাড়া দেননি।
বিষয়টি নিয়ে জেলা পরিবেশ কার্যালয়ের উপ-পরিচালক নয়ন মিয়ার সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি কল ধরেননি।