কাপাসিয়ায় সাধারণ মানুষের ‘সাবমারসিবল পাম্প’ পাচ্ছে বিত্তশালীরা, কাজে ব্যাপক দুর্নীতি

ঘটনার আড়ালে প্রতিবেদন : কাপাসিয়া-চাঁদপুর সড়কের পূর্ব পাশে চাকৈল এলাকায় ফয়সাল ফাহাদ নার্সারি। কান্দানিয়া এলাকার কামাল হোসেন প্রধান জমি ভাড়া নিয়ে নার্সারিটি করেছেন।
নার্সারির বিভিন্ন জাতের চারায় পানি দেওয়ার জন্য একটি সরকারি সাবমারসিবল পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। এটি বসতবাড়ি না হলেও বরাদ্দ বাগিয়ে নিয়েছেন কামাল।
গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ভর্তুকির পাম্প বরাদ্দ এবং নির্মাণ কাজে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে। ফলে সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
নিরাপদ পানি সরবরাহের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপজেলা কার্যালয়। আর্থিক ও সামাজিকভাবে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে পানির উৎস স্থাপনের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার প্রদানের নির্দেশনা রয়েছে।
সাবমারসিবল পাম্পযুক্ত গভীর নলকূপের সরকার নির্ধারিত ফি ১০ হাজার টাকা। বরাদ্দকৃত পাম্পের ৫০ ভাগ উপকারভোগী স্থানীয় সংসদ সদস্য কর্তৃক ও অবশিষ্ট ৫০ ভাগ ইউনিয়ন পরিষদ এবং উপজেলা পরিষদ কর্তৃক নির্বাচন করা হয়। পরে উপজেলা ওয়াটসন কমিটি কর্তৃক তালিকা অনুমোদিত হয়ে জেলা জনস্বাস্থ্য নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে যায়।
সরেজমিনে জানা যায়, দুর্গাপুর ইউনিয়নের নাজাই এলাকার আবদুল গাফফার ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি। তিনি ডিশ লাইনের ব্যবসা করেন। বাউন্ডারি ওয়ালের ভেতরে ফাউন্ডেশন দিয়ে করেছেন বাড়ি। গাজীপুর ও শ্রীপুরের মাওনা এলাকায় তার আরও দুটি বাড়ি রয়েছে।
এই বিত্তশালী গাফফারও সরকারি পাম্প পেয়েছেন। পাম্পটি বাড়ির সামনে স্থাপন করা হয়েছে। তবে ট্যাংকি পাকা হাউজের সঙ্গে নিচে থাকার নিয়ম থাকলেও তা বসানো হয়েছে বাড়ির ছাদে।
আবদুল গাফফারের বাড়ির উত্তরে আড়াই কাঠা জমিতে তিন তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে বাড়ির নিচ তলা সম্পন্ন করেছেন রানা। তিনি রাজেন্দ্রপুর এলাকার বহুজাতিক নেসলে কোম্পানিতে চাকরি করেন। তাকেও সরকারি পাম্প দেওয়া হয়েছে। তার পাম্পের ট্যাংকিও বাড়ির ছাদে।
রাওনাট পঞ্চায়েতবাড়ী এলাকার ফারুক সরকার দীর্ঘদিন ধরে কুয়েত প্রবাসী। বরুন-চাঁদপুর সড়কে তিনি একটি তিন তলা বাড়ি করেছেন। তার পরিবার সেখানেই থাকে।
অথচ ফারুক সরকারের পৈতৃক ভিটায় পাম্প দেওয়া হয়েছে। তারা মাঝে-মধ্যে সেখানে গেলে পাম্প চালু করেন। বাকি সময় পাম্পটি বন্ধ থাকে। তার ভাই আহসান সরকার ওই ভিটায় আলাদা পাকা বাড়ি করেছেন। নিজস্ব মটর থাকায় তাদের সেটা ব্যবহার করতে হয় না।
দুর্গাপুর ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের মেম্বার আমজাদ হোসেন ওরফে কোটিপতি আমজাদ। তিনি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি। তার ছেলে আশিক মাহমুদ রেলওয়েতে গেটকিপার পদে চাকরি করেন।
এই ইউপি মেম্বারও একডালা এলাকার বাড়িতে সরকারি পাম্প স্থাপন করেছেন। তার পাম্পের ট্যাংকিও বাড়ির ছাদে।
ঘিঘাট উত্তরপাড়া এলাকার শহিদুল্লাহ রাণীগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের নৈশপ্রহরী। তার বাড়ি ঘেঁষে পশ্চিম পাশে ভাই শারফুদ্দিনের ফাউন্ডেশন বাড়ি। এর দক্ষিণ পাশে মা রোকেয়ার টিনশেড বাড়ি।
এই তিন বাড়িতে তিনটি সরকারি পাম্প দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে শারফুদ্দিনের পাম্প স্থাপন করা হয়েছে ঘরের ভেতরে ও ট্যাংকি বাড়ির ছাদে। তার ছেলে খলিল প্রায় এক যুগ ধরে সিঙ্গাপুরে চাকরিরত আছেন।
গোসাইরগাঁও এলাকার আল-আমিন সৌদি আরব প্রবাসী। তার বাড়িতে সরকারি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। পাম্পটি ঘিঘাট এলাকার ছাত্রলীগ নেতা সোহাগ দাস তার নামে এনে হাতবদল করেছেন। তাই পাম্পের নেম প্লেটে উপকারভোগীর নাম উল্লেখ করা হয়নি।
দুর্গাপুর উত্তরপাড়া এলাকার লোকমান হোসেনের বাড়ির পাশে গরুর খামার। তার স্ত্রী নাজমার নামে সরকারি পাম্প এনে খামারের সামনে স্থাপন করা হয়েছে। পাশে দুটি বাড়ি থাকলেও তাদের নিজস্ব মটর আছে। পাম্পটি এককভাবে লোকমান পরিবারের খামারের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।
এর দক্ষিণে জসিম উদ্দিনের পাকা বাড়ি। আগে থেকেই তার ও তার ভাই দুলাল হোসেনের পৃথক মটর আছে। এরপরও তাকে সরকারি পাম্প দেওয়া হয়েছে। পুরনো ট্যাংকি হাউজে বসিয়ে নতুন ট্যাংকি তিনি ঘরের ভেতরে রেখে দিয়েছেন।
চর দুর্গাপুর এলাকার সফিকুল ইসলাম ওরফে ফালাইন্না ২০২২ সালে চাকরি নিয়ে দুবাই গেছেন। তাকে সরকারি পাম্প দেওয়া হয়েছে। তবে পাম্পটি তার বাড়িতে স্থাপন করা হয়নি। স্থাপন করা হয়েছে বাড়ি থেকে কিছু দূরে একটি টিনের চালার নিচে। সেখানে তিনি ভবিষ্যতে বাড়ি করবেন।
বাড়ৈগাঁও এলাকার সাদেক দুর্গাপুর ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি। তার বাড়িতে আগে থেকেই মটর আছে। এরপরও সরকারি পাম্প পেয়েছেন তিনি।
সাফাইশ্রীর দক্ষিণ দিকে রাণীগঞ্জ সড়কের পূর্ব পাশে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোতাহার হোসেন মোল্লার এগ্রো প্রজেক্ট। প্রজেক্টের কলা বাগানসহ অন্যান্য অংশে পানি দেওয়ার জন্য সরকারি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে।
সনমানিয়া ইউনিয়ন পরিষদের প্রয়াত চেয়ারম্যান আবদুল মালেক ভূইয়ার বাড়িতে দুটি সরকারি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। একটি বাড়ির ভেতরে ও আরেকটি বাড়ির বাইরে গোয়ালঘরের সামনে। মানুষের দৃষ্টি এড়াতে বাড়ির ভেতরের পাম্পের হাউজ করা হয়নি।
পাম্প স্থাপনের স্থান নির্বাচন সংক্রান্ত নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, সাবমারসিবল পাম্প স্থাপনের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ১০টি পরিবারকে পানি সরবরাহের আওতায় আনার লক্ষ্যে বাড়ির বাইরে আউটলেট রাখতে হবে। অর্থাৎ বসতবাড়ি ব্যতীত অন্যত্র পাম্প স্থাপনের সুযোগ নেই। কোন পাম্প ঘরের ভেতরেও রাখা যাবে না।
বিভিন্ন এলাকার লোকজন বলেছেন, অর্থবিত্ত ও ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরা দেদারসে সরকারি পাম্প পাওয়ায় সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছেন। অনেকে ধরনা দিয়েও পাম্প পাচ্ছেন না। আবার যার নিজের মটর সচল আছে, সে-ও পাম্প পাচ্ছে। কোথাও কোথাও দালালদের মাধ্যমে পাম্পপ্রতি নেওয়া হচ্ছে ২০-৩০ হাজার টাকা। সংশ্লিষ্টদের দুর্নীতি, অবহেলা ও স্বজনপ্রীতিতে সরকারের কল্যাণমূলক উদ্যোগের সুফল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
অপরদিকে পাম্প স্থাপনের কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি রায়েদ, সিংহশ্রী ও টোক ইউনিয়নে পাম্প হাউজ নির্মাণে দুই নম্বর ও তিন নম্বর ইট দেওয়া, সিমেন্ট কম দেওয়া, খোয়া কম দেওয়া, বালু কম দেওয়া, কম মিলির রড দেওয়া এবং গ্রাহককে দিয়ে দুটি চাবিসহ কিছু সামগ্রী কেনানোর তথ্য পাওয়া গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীর কার্যালয়ের একাধিক মেকানিক কৌশলে নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহের ঠিকাদারি করছেন। তাদেরকে সুযোগ দিয়ে উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী মোহাম্মদ রেজাউর রহমান লাভবান হচ্ছেন।
জানতে চাইলে উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী মোহাম্মদ রেজাউর রহমান ঘটনার আড়ালে-কে বলেন, যে বাড়িতে মটর আছে, সে বাড়িতে পাম্প দেওয়া হয় না। তবে এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউপি চেয়ারম্যান লিস্ট দিলে অনেক ক্ষেত্রে অগ্রাহ্য করা যায় না।
নার্সারি বা এগ্রো প্রজেক্টে পাম্প দেওয়ার সুযোগ আছে কি না-এমন প্রশ্নের উত্তরে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী বলেন, এটা তো পানি খাওয়ার জন্য দেওয়া হয়। কেউ যদি গাছে-টাছে পানি দেয়, দিতে পারে।
কর্মচারীদের ঠিকাদারি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মেকানিকরা কাজ তদারকি করেন। যদি তারা ঠিকাদারি করে থাকেন, তাহলে আমি দেখব।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button