গাজীপুরে বনের নিষিদ্ধ এলাকায় হাবিতুস ফ্যাশন, তথ্য গোপন করে ৭ ডিমারকেশন ও ছাড়পত্র!
ঘটনার আড়ালে প্রতিবেদন : গাজীপুরে বন বিভাগের নিষিদ্ধ ঘোষিত এলাকায় ফর্টিস গ্রুপের বৃহৎ হাবিতুস ফ্যাশন লিমিটেড গড়ে উঠেছে। ক্রমান্বয়ে বাড়ছে আয়তন। হুমকির মুখে পড়েছে বন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।
শিল্প কারখানাটি বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান রেঞ্জের বাউপাড়া বিটের গজারিয়াপাড়া এলাকায় অবস্থিত। যা সংরক্ষিত কোর জোন হিসেবে চিহ্নিত।
অনুসন্ধানে জানা যায়, হাবিতুস ফ্যাশন ওই স্থানে জমি কিনে ২০১৪ সালে কারখানার নির্মাণ কাজ শুরু করে। ২০১৬ সালের শেষ দিকে পুরোদমে পোশাক পণ্যের উৎপাদন শুরু হয়। পরে ক্রমান্বয়ে কারখানার পরিসর সম্প্রসারণ করে ইউনিট বাড়ানো হয়।
কারখানাটির উত্তর, পশ্চিম-দক্ষিণ ও পূর্ব পাশে সংরক্ষিত বনভূমি। পশ্চিম পাশ ঘেঁষে আকাশমনি বাগান। উত্তর পাশ ঘেঁষে গজারিসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা। কারখানা নির্মাণের সময় পূর্ব পাশে বনভূমি দখল করে প্রবেশ পথ তৈরি করা হয়।
বনভূমি দখল করে কারখানার প্রবেশ পথ
বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ অনুযায়ী, গাজীপুর জাতীয় উদ্যান বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য এলাকা। অভয়ারণ্য এলাকার সীমানা হতে দুই কিলোমিটার পর্যন্ত কোর জোন। কোর জোনে কোন শিল্প কারখানা স্থাপন বা পরিচালনা নিষিদ্ধ। এই বিধান লঙ্ঘন জামিন অযোগ্য ও দণ্ডনীয় অপরাধ।
ফর্টিস গ্রুপ নিষিদ্ধ এলাকায় জমি কিনে শুরুতেই কৌশলী হয়। ক্রেতা বা প্রস্তাবিত কারখানার নাম গোপন করে ২০১৩ সালে চারজন বিক্রেতার নামে আবেদন করে চারটি ডিমারকেশন বাগিয়ে নেয়।
বন বিভাগের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ঢাকার গুলশানের এ কে এম রুহুল আমিনের নামে জেলা প্রশাসন ২০১৩ সালের মে মাসে প্রথমে ৮৫ শতাংশ জমির ডিমারকেশন অনুমোদন করে। যার সীমানা নির্ধারণী মোকদ্দমা নম্বর ৬/২০১৩।
পরে একইভাবে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে জাঙ্গালিয়াপাড়া এলাকার বর্তমান ওয়ার্ড কাউন্সিলর ছবদের হাসানের নামে ৫২ শতাংশ জমির ডিমারকেশন অনুমোদন হয় (সীমানা নির্ধারণী মোকদ্দমা নম্বর ৬৪/২০১৩), বাহাদুরপুর এলাকার হযরত আলীর নামে সাড়ে ৯৬ শতাংশ জমির ডিমারকেশন অনুমোদন হয় (সীমানা নির্ধারণী মোকদ্দমা নম্বর ১১৫/২০১৩) ও বাহাদুরপুর এলাকার জবেদা খাতুনের নামে ৫২ শতাংশ জমির ডিমারকেশন অনুমোদন হয় (সীমানা নির্ধারণী মোকদ্দমা নম্বর ১১৬/২০১৩)।
ফর্টিস গ্রুপ যখন আড়াইশ প্রসাদ ও বাহাদুরপুর মৌজায় জমি কিনে ডিমারকেশনের কার্যক্রম শুরু করে, তখন বাউপাড়া বিট কর্মকর্তা ছিলেন মোহসীন হাওলাদার। ওই সময় পার্ক রেঞ্জ কর্মকর্তা ছিলেন বজলুর রহমান ভূঁইয়া ও বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ছিলেন সাহাব উদ্দিন। তাদের মধ্যে বজলুর রহমান ভূঁইয়া এখন অবসরে আছেন। আর সাহাব উদ্দিন অবসরে যাওয়ার পর মারা গেছেন।
কোম্পানিটি বিট কর্মকর্তা মোহসীন হাওলাদারের সঙ্গে পরামর্শ ও চুক্তি করেই পৃথক পৃথক ডিমারকেশনের জন্য জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে আবেদন করে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে প্রতিবেদনের জন্য বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কাছে চিঠি পাঠানো হয়। পরে ডিএফও সাহাব উদ্দিন বিট কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেন। দায়িত্ব পেয়ে মোহসীন হাওলাদার মাপজোখ ও স্কেচম্যাপসহ প্রতিবেদন তৈরি করেন।
তাতে কোর জোনের তথ্য সম্পূর্ণ গোপন করা হয়। এরপর তিনি ডিমারকেশন অনুমোদনের সুপারিশ করে প্রতিবেদনগুলো ডিএফও কার্যালয়ে পাঠান। সেখান থেকে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে পাঠানোর পর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ডিমারকেশন অনুমোদন করেন।
এর মধ্যে আবেদনের সময় মালিকানা না থাকলেও জবেদা খাতুনের নামে ১১৬/২০১৩ নম্বর ডিমারকেশন হয়েছে। বিট কর্মকর্তা মোহসীন হাওলাদার নিজেই প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, জবেদা খাতুনের ওই জমি গজারিয়াপাড়ার দেনাতুল্যা ও তার স্ত্রীর নামে হস্তান্তর হয়। পরে দেনাতুল্যার স্ত্রী ও ছেলে তাদের জমি হাবিতুস ফ্যাশনের পক্ষে ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহাদাত হোসেনের কাছে হস্তান্তর করেন।
ডিমারকেশনগুলো পেয়েই ২০১৪ সালে শুরু হয় কারখানার বড় বড় ভবনসহ স্থাপনা নির্মাণের কাজ। নামকরণ হয় হাবিতুস ফ্যাশন। ২০১৫ সালের ১৮ জুন কারখানাটির অনুকূলে দুটি মৌজায় প্রায় ৬৫০ শতাংশ জমির অনাপত্তির ছাড়পত্র প্রদান করে বন বিভাগ।
মোহসীন হাওলাদার ২০১১ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৫ সালের ১০ জুন পর্যন্ত বাউপাড়া বিটের দায়িত্বে ছিলেন। ওই ডিএফওর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত মোহসীন হাওলাদার ফর্টিস গ্রুপকে ডিমারকেশন ও কারখানা স্থাপনের সুযোগ দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ। তিনি সরকারবিরোধী প্রচারণার অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত হয়ে বর্তমানে ঢাকা সামাজিক বন বিভাগে ন্যস্ত আছেন।
এ ব্যাপারে মোহসীন হাওলাদারের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করলে তিনি প্রথমে তার সময়ে হাবিতুস ফ্যাশনের কাজ শুরু হওয়ার কথা স্বীকার করেন। কোর জোনের প্রসঙ্গ আনলে তিনি ব্যস্ততা দেখিয়ে পরে কথা বলেন।
এবার মোহসীন হাওলাদার ঘটনার আড়ালের কাছে দাবি করেন, তার সময়ে চারটি নয়, একটি ডিমারকেশন হয়েছে। তিনি কারখানার কোন কাজ করতে দেননি। কারখানাটি তার বদলির পর হয়েছে।
মোহসীন হাওলাদার বলেন, হাবিতুস ফ্যাশনের পক্ষে এলাকার নাজমুল (বর্তমানে জিএম) দালালি করতেন। নাজমুল টাকার ব্রিফকেস নিয়ে তার বাসায় গিয়েছিলেন। তিনি ব্রিফকেসে লাথি মেরেছিলেন।
মোহসীন হাওলাদার আরও বলেন, আমি হাবিতুসের পশ্চিম পাশের ওয়াল ভাঙচুর করে দেড় বিঘার মত বনভূমি উদ্ধার করেছি। নাজমুলসহ তাদের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা দিয়েছি। রেঞ্জার আমার নাম ভাঙিয়ে টাকা নিয়েছে।
তবে খোঁজ নিয়ে হাবিতুস ফ্যাশনের বিরুদ্ধে একটি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। মোহসীন হাওলাদার ২০১৪ সালের ২৩ মে কারখানাটির এমডি শাহাদাত হোসেনসহ তিনজনের বিরুদ্ধে পিওআর মামলা করেছেন। মামলা নম্বর ১৪। মামলার আসামির ক্রমিকে নাজমুল হোসেনের নাম নেই।
ডিমারকেশনগুলো সম্পন্ন হওয়ার পরের বছর দায়েরকৃত মামলায় সীমানা পিলার অপসারণ করে বনভূমি দখল ও আকাশমনি গাছ কর্তনের অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলাটি বর্তমানে গাজীপুর বন আদালতে বিচারাধীন।
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ঢাকার মিরপুরের পল্লবী এলাকার লিয়ার হোসেনের নামে ১৫ শতাংশ জমির ডিমারকেশন অনুমোদন করেন জেলা প্রশাসক। যার সীমানা নির্ধারণী মোকদ্দমা নম্বর ১৫৬/২০১৭। এই ডিমারকেশন অনুমোদনের জন্য প্রতিবেদন দাখিল করেন বিট কর্মকর্তা খন্দকার আরিফুল ইসলাম।
আরিফুল ইসলাম ২০১৬ সালের ১০ জুলাই থেকে ২০১৯ সালের ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত বাউপাড়া বিটে কর্মরত ছিলেন। ওই সময় পার্ক রেঞ্জ কর্মকর্তা ছিলেন আবুল হাশেম ও বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ছিলেন এ এস এম জহির উদ্দিন আকন।
তাদের মধ্যে আবুল হাশেম সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) পদে পদোন্নতি পেয়ে অবসরে গেছেন। জহির উদ্দিন আকন বন সংরক্ষক (সিএফ) পদে পদোন্নতি পেয়ে এখন যশোর সামাজিক বন অঞ্চলের দায়িত্বে আছেন। আর আরিফুল ইসলাম আছেন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপকূলীয় রেঞ্জের বগাচতর বিটে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিট কর্মকর্তা আরিফুল ইসলাম ও রেঞ্জ কর্মকর্তা আবুল হাশেমের আমলে হাবিতুস ফ্যাশনের পুরোদমে উৎপাদন এবং কারখানা সম্প্রসারণ হয়। তারা মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে কোর জোন, জবর দখল ও মামলার তথ্য গোপন করে ডিমারকেশনের প্রতিবেদন দাখিল করেন। সে সময় ডিএফও জহির উদ্দিন আকনও রহস্যজনক কারণে নীরব ছিলেন।
সূত্র আরও জানায়, আরিফুল ইসলাম একবার কিছু আকাশমনি চারা রোপণ করে পূর্ব পাশের গেটের রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পরে কারখানার লোকজন চারাগুলো তুলে ফেলে রাস্তা আবার বহাল করেন। এ ঘটনায়ও তিনি সুবিধা নিয়ে কোন ব্যবস্থা নেননি।
জানতে চাইলে জহির উদ্দিন আকন ঘটনার আড়ালে-কে বলেন, তিনি হাবিতুস ফ্যাশনের বিষয়ে শুনেছেন। কিন্তু অনেক দিন আগের হওয়ায় কিছু মনে পড়ছে না।
মোনায়েমের বড় কারসাজি : বিট কর্মকর্তা মোনায়েম হোসেন ২০২১ সালের ৩১ মার্চ বাউপাড়া বিটে যোগদান করেন। যোগ দিয়েই তিনি শিল্প কারখানার দিকে নজর দেন। মন্ত্রীর ছেলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা বলে শুরু হয় অসম্ভবকে সম্ভব করার চুক্তি।
এবার হাবিতুস ফ্যাশন দুটি ডিমারকেশন বাগিয়ে নেয়। একটি কারখানার নামে (সীমানা নির্ধারণী মোকদ্দমা নম্বর ৩১/২০২১) ও অপরটি সালনা এলাকার ফারুক হোসেনের নামে (সীমানা নির্ধারণী মোকদ্দমা নম্বর ৩০/২০২১)। এক একর ৩৪ শতাংশ ও এক একর ৭৮ শতাংশ জমির ডিমারকেশন দুটি জেলা প্রশাসক ২০২২ সালের ৬ জুন অনুমোদন করেন।
এর আগে বিট কর্মকর্তা মোনায়েম হোসেন ২০২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর নিষিদ্ধ এলাকার দূরত্বে কারসাজি, জবর দখল, মামলা এবং বন ও পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতির তথ্য গোপন করে প্রতিবেদন দাখিল করেন। মোটা অঙ্কের টাকার এই চুক্তিতে সাবেক বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজল তালুকদার প্রত্যক্ষভাবে জড়িত বলে অভিযোগ।
মোনায়েম হোসেন ডিমারকেশনের প্রতিবেদন দুটিতে উল্লেখ করেন, আবেদিত ভূমি হতে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের দূরত্ব ২.০৩ কিলোমিটার। আবেদনকারীরা পরিবেশ, বন ও বন্যপ্রাণীর ক্ষতিসাধন হয়-এমন কোন কর্মকাণ্ড করবেন না মর্মে অঙ্গীকারনামা দাখিল করেছেন।
অথচ হাবিতুস ফ্যাশন জাতীয় উদ্যানের পশ্চিম দিকে মিয়াবাড়ি-বাংলাবাজার রোডে অবস্থিত। দূরত্ব পরিমাপক যন্ত্র জিপিএস ও গুগল অ্যাপ এয়ার-লাইনে পার্কের সীমানা থেকে কারখানাটি শুরুর পূর্ব অংশের দূরত্ব প্রায় দেড় কিলোমিটার ও শেষ প্রান্ত পশ্চিম অংশের দূরত্ব সর্বোচ্চ পৌনে দুই কিলোমিটার।
একাধিক ওয়াকিবহাল সূত্র জানায়, বিশেষ ডিমারকেশনের ক্ষেত্রে ডিএফও নিজে আবেদিত স্থান পরিদর্শন করে বিধি-বিধান প্রতিপালন হচ্ছে কি না যাচাই করেন। কিন্তু হাবিতুস ফ্যাশনের বিষয়ে কাজল তালুকদার আবেদিত স্থান পরিদর্শন করলেও ভাগ-বাটোয়ারায় সন্তুষ্ট হয়ে সম্পূর্ণ নীরব থাকেন।
সূত্র আরও জানায়, মোনায়েম হোসেন হাবিতুস ফ্যাশন থেকে জাতীয় উদ্যানের দূরত্ব নির্ণয়ে বন বিভাগের নির্দেশিত অত্যাধুনিক জিপিএস ডিভাইস ব্যবহার করেছেন। তিনি কারখানা থেকে বরাবর পূর্ব দিকে রিডিং না নিয়ে ডান দিকে বাঁকা করে রাজেন্দ্রপুর চৌরাস্তাকে পয়েন্ট ধরেছেন। আর এই অপকৌশলে দেড় কিলোমিটারের দূরত্ব হয়ে গেছে দুই কিলোমিটারের বেশি।
এদিকে ডিমারকেশন পেয়ে কারখানা আরও সম্প্রসারণ করছে হাবিতুস ফ্যাশন। পূর্ব অংশে একটি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। সম্প্রতি পাঁচ তলার ছাদ ঢালাই সম্পন্ন হয়েছে। কারখানার দক্ষিণ দিকে বন সংলগ্ন বিস্তীর্ণ ফসলি জমি কিনে বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণ ও দেদারসে বালু ভরাট করা হচ্ছে। ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় বৃষ্টি হলেই সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় ভোগান্তি পোহাচ্ছেন এলাকাবাসী। ঝুঁকির মুখে পড়েছে বনাঞ্চল।
কৃষি জমি ভরাট করে কারখানা আরও বড় করার প্রস্তুতি
কারখানাটির পশ্চিম পাশে ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই। ফলে বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁষে প্রায় এক বিঘা বনভূমি দীর্ঘদিন ধরে জলাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। সেখানে কারখানার ভেতর থেকে ফেলা হচ্ছে দূষিত পানি। বনায়ন করতে না পারায় বনজ সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। চলতি মাসের বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করে।
এ ছাড়া কারখানার পশ্চিম পাশে একটি ক্যানটিন নির্মাণ করা হয়েছে। ক্যানটিনে চলাচলের রাস্তা বনভূমির ওপর দিয়ে। ক্যানটিন থেকে ফেলা প্লাস্টিকসহ অন্যান্য বর্জ্যে পূর্ব ও পশ্চিম পাশের আকাশমনি বাগান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ডিমারকেশন দুটি অনুমোদনের আগে ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর সাবেক সহকারী বন সংরক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ আবেদিত ভূমি পরিদর্শন করে কিছু নির্দেশনা দেন। পরদিন মোনায়েম হোসেন হাবিতুস ফ্যাশনের এমডিকে বনাঞ্চল ও পরিবেশের ক্ষতিসাধন প্রসঙ্গে একটি নোটিশ দেন। যার পত্র নম্বর ২৭৪/বাউ-১৫।
এতে বলা হয়, কারখানাটির বর্জ্য কারখানার দক্ষিণ-পূর্ব অংশের দেয়ালের বাইরে এবং পাম্প মেশিনের সাহায্যে দূষিত পানি বনের অভ্যন্তরে ফেলা হচ্ছে। ক্যানটিনের রাস্তা দিয়ে কারখানার হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারী যাতায়াতের ফলে বনাঞ্চলের গাছপালার স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহতসহ বাস্তুতন্ত্র ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে বিনষ্ট, প্রাকৃতিক পুনর্জন্ম ধ্বংস এবং বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংসের মুখে পতিত হচ্ছে। এসব অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে কারখানা সংশ্লিষ্ট বনাঞ্চলের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে।
নোটিশে সাত দিনের মধ্যে ক্যানটিনের ব্যবহৃত রাস্তা বন্ধ, বাগান এলাকার বর্জ্য অপসারণ এবং জবর দখলকৃত আরএস ৭৮৪ ও ৭৮৬ নং দাগের আংশিক বনভূমি অবমুক্ত করতে বলা হয়। অন্যথায় প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
কিন্তু বাস্তবে কারখানার মালিক কোন কিছুই করেননি। মোনায়েম হোসেনও বন আইনে কোন ব্যবস্থা নেননি। শুধু কাগজে-কলমে নিয়ম পালন করা হয়।
২০২২ সালে অনুমোদিত দুটি ডিমারকেশনের আগে পরিবেশগত ছাড়পত্রের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরে আবেদন করে হাবিতুস ফ্যাশন। পরে জেলা পরিবেশ কার্যালয়ের চিঠির প্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ২৯ মার্চ ডিএফও কাজল তালুকদার প্রতিবেদনের জন্য রেঞ্জ কর্মকর্তা কাজী নাজমুল হককে নির্দেশ দেন।
দায়িত্ব পেয়ে বিট কর্মকর্তা মোনায়েম হোসেন প্রতিবেদন তৈরি করে ১১ এপ্রিল দাখিল করেন। এটাই ছিল তার শিল্পকেন্দ্রিক বাণিজ্যের প্রথম কাজ।
হাবিতুস ফ্যাশনের পূর্বের ডিমারকেশনকৃত ৩০৫.৮৬ শতাংশ জমির বিপরীতে পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদানের সুপারিশ করে মোনায়েম হোসেন প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, জাতীয় উদ্যান থেকে কারখানার দূরত্ব ২.০৩ কিলোমিটার বা দুই হাজার ২৯ মিটার। কারখানাটি জিপিএস রিডিংয়ে কোর জোনের বাইরে বিধায় বন্যপ্রাণী আইন, ২০১২-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বনভূমির ওপর কারখানার কোন প্রভাব পড়বে না।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, হাবিতুস ফ্যাশন ২০১৪ সালের ১ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হয়ে বর্তমানে চালু অবস্থায় রয়েছে। শিল্প কারখানাটি বন্যপ্রাণী আইন, ২০১২-এর পরে প্রতিষ্ঠিত হলেও জাতীয় উদ্যান থেকে দুই কিলোমিটারের বাইরে।
ডিএফওর চাহিত ১১টি তথ্যের মধ্যে ৭ নম্বর ক্রমিকে কারখানার সঙ্গে বন বিভাগের বনভূমি সম্পর্কিত কোন মামলা-মোকদ্দমা আছে কি না প্রসঙ্গ রয়েছে। মোনায়েম হোসেন প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে কারখানার সঙ্গে বন বিভাগের কোন মামলা নেই।
কোম্পানির প্রোফাইলে উল্লেখ আছে, ফর্টিস গ্রুপের হাবিতুস ফ্যাশন ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কারখানাটিতে স্থাপন করা হয়েছে দুই হাজার ৩০০টি মেশিন। মাসে পণ্য উৎপাদনের সক্ষমতা ১৫ লাখ পিস।
অপরদিকে হাবিতুস ফ্যাশন ২০১৭ সালে ১.১ মেগাওয়াট ক্ষমতার ডিজেলচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন প্ল্যান্ট চালু করেছে। নিষিদ্ধ এলাকার তথ্য গোপন করে তারা ওই বছরের জুলাইয়ে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন থেকে লাইসেন্সও নিয়েছে। বিইআরসির ১৫৩তম সভায় এ অনুমোদন দেওয়া হয়।
গত বছর ডিমারকেশনের কার্যক্রম চলার সময় কারখানায় যোগাযোগ করলে প্রশাসনিক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম গেটের বাইরে এসে কথা বলেন। তিনি জেনারেল ম্যানেজার নাজমুল হোসেনের মোবাইল নম্বর দিয়ে কথা বলতে বলেন।
পরে জবর দখলের নোটিশের বিষয়ে জানতে চাইলে জিএম নাজমুল হোসেন বলেন, সেটা বিট অফিসের বাটপারি। কোর জোনে কারখানা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এসব আজাইরা বক্তব্য দেওয়ার মত মুড তার নেই।
অভিযুক্ত বিট কর্মকর্তা মোনায়েম হোসেন ইতিপূর্বে বদলি হয়ে চট্টগ্রাম বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগে আছেন। তিনি নিয়মের বাইরে কোন কিছু করেননি বলে দাবি করেন।
অপর অভিযুক্ত কাজল তালুকদার এখন চট্টগ্রামের বন ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা বিভাগের ডিএফও হিসেবে আছেন। জানতে চাইলে তিনিও কোন ধরনের অনিয়ম করেননি বলে দাবি করেন।
কাজল তালুকদার ঘটনার আড়ালে-কে বলেন, মোনায়েম হোসেন দূরত্ব মেপেই প্রতিবেদন দিয়েছেন। তার সময়ে মোনায়েম হোসেন নিয়মের বাইরে কোন কিছু করেননি।
তিনি আরও বলেন, ডিমারকেশনের প্রতিবেদন নিচ থেকে বিট কর্মকর্তা ও রেঞ্জ কর্মকর্তা হয়ে তার কাছে যায়। এত দিন পর এটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করাই ভালো।
একাধিক বন কর্মকর্তা বলেন, কোর জোনে হাবিতুস ফ্যাশনের কারখানা স্থাপন, পরিচালনা ও সম্প্রসারণ গুরুতর অপরাধ। কারখানাটি বন্ধ ও ক্ষতিপূরণ আদায়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। একই সঙ্গে যেসব কর্মকর্তা ঘুষের বিনিময়ে আইন লঙ্ঘন করে বন ও পরিবেশ-প্রতিবেশ ব্যবস্থার বিপুল ক্ষতিসাধনের সুযোগ দিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
আরও পড়ুন : গাজীপুরে বন কেটে কারখানার স্থাপনা, ফরেস্টার মোনায়েমের বাণিজ্য ১৬ লাখ!