গাজীপুরে বন কেটে কারখানার স্থাপনা, ফরেস্টার মোনায়েমের বাণিজ্য ১৬ লাখ!
ঘটনার আড়ালে প্রতিবেদন : গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর চৌরাস্তা থেকে বাংলাবাজার রোডে এগোলে আম্বার ডেনিমের পূর্ব পাশে গ্লোবাল ফিট (বাংলাদেশ) লিমিটেড। কারখানাটিতে বিভিন্ন পোশাক পণ্য উৎপাদন হয়। তবে এই স্থাপনা সাবেক বেন্টলী সোয়েটার ইন্ডাস্ট্রিজ নামেই বেশি পরিচিত।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকার সাবেক এমপি ডা. এইচ বি এম ইকবাল আড়াইশ প্রসাদ মৌজার জাঙ্গালিয়াপাড়া এলাকায় দেড় যুগ আগে বিপুল পরিমাণ জমি কিনেন। তখন জোত জমির সঙ্গে সিএস ১৯ এবং আরএস ৪০, ৪২, ৪৩, ৪৪ ও ৪৫ নং দাগের তিন একর ৬৪ শতাংশ গেজেটভুক্ত বনভূমি দখল করা হয়।
রাস্তা সংলগ্ন পূর্ব পাশের দখলকৃত অংশে কারখানার গেট, গাড়ি পার্কিং এরিয়া ও কিছু অংশে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। বাকি অংশ কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ভোগদখল করা হচ্ছে। স্থানটি বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের জাতীয় উদ্যান রেঞ্জের বাউপাড়া বিটের অধীন।
বেন্টলী বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এলিগেন্স সোয়েটার কারখানাও ওই স্থাপনা ভাড়া নিয়েছিল। কয়েক বছর চালানোর পর তারা অন্যত্র চলে যায়।
গত বছর বেন্টলীর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় গ্লোবাল ফিট। কারখানাটিতে প্রবেশের পথসহ গুরুত্বপূর্ণ অংশসমূহ বনভূমি। গ্লোবাল ফিটের মালিক গত বছরের জুনে সংস্কার ও সম্প্রসারণ কাজ শুরু করলে সাবেক বিট কর্মকর্তা মোনায়েম হোসেন গিয়ে বাধা দেন। পরে তিনি মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে অনুমতি দিলে পর্যায়ক্রমে সকল কাজ সম্পন্ন হয়।
বনে স্থাপনার নির্মাণ কাজ শুরুর এই ছবি ২০২২ সালের ১৩ জুলাই তোলা
বনভূমিতে নতুন স্থাপনার মধ্যে রয়েছে জেনারেটরের পাকা রুম ও মাটি খনন করে কারখানার নির্গত পানি জমা রাখার বড় হাউজ। জেনারেটরের রুম মূল ভবনের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে ও পানির হাউজ পশ্চিম পাশে। গভীর হাউজটি নির্মাণ করতে গিয়ে সেগুনসহ কিছু গাছ কাটা হয়েছে।
এ ছাড়া এক স্থাপনা থেকে আরেক স্থাপনায় চলাচলের সুবিধার জন্য দুটি ইটের সলিং রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। মূল ভবনের পশ্চিম পাশে নির্মাণ করা হয়েছে শতাধিক ফুট দৈর্ঘ্যের পাঁচ ফুট উঁচু বাউন্ডারি ওয়াল। দক্ষিণ অংশে দেওয়া হয়েছে লোহার তৈরি বেড়া।
বন দিয়ে নতুন ইটের সলিং রাস্তা
বিট অফিস সূত্র জানায়, মোনায়েম হোসেন মন্ত্রীর ছেলের নাম ভাঙিয়ে দাপট দেখাতেন। খোদ সাবেক বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজল তালুকদারও তার প্রতি নমনীয় ছিলেন। তিনি বড় বড় দুর্নীতি করে রাষ্ট্রীয় সম্পদের সর্বনাশ করেছেন।
সূত্র আরও জানায়, মোনায়েম হোসেন গ্লোবাল ফিটের কাছ থেকে ১৬ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে প্রচার রয়েছে। কাজ চলেছে পুরো এক বছর ধরে। এর ফলে নতুন করে প্রায় আধা বিঘা বনভূমি গ্রাস ও বনের আকৃতি-প্রকৃতি পরিবর্তনে পরিবেশ-প্রতিবেশ ব্যবস্থার বিপুল ক্ষতিসাধন হয়েছে।
বনে গ্লোবাল ফিটের নতুন বাউন্ডারি ওয়াল
মোনায়েম হোসেন গত ১০ জুলাই বাউপাড়া বিট ছেড়েছেন। তিনি বিটটিতে দুই বছর চার মাসেরও বেশি সময় কর্মরত ছিলেন। এর আগে প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসাইন চৌধুরী গত ৮ মে তাকে চট্টগ্রামে বদলির নির্দেশ দেন।
কিন্তু মোনায়েম হোসেন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অমান্য করে ভাওয়াল অথবা পার্ক রেঞ্জ কর্মকর্তার দায়িত্ব পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। এক পর্যায়ে স্ট্যান্ড রিলিজের আদেশ জারি হলেও তিনি কিছুদিন বহাল থেকে কোন উপায় না পেয়ে অবশেষে গাজীপুর ছাড়েন।
এর আগে ২০১৬ সালে সাবেক এলিগেন্স সোয়েটার কারখানার মালিক গাছ কেটে একটি জেনারেটর রুম নির্মাণ করেছিলেন। তখনকার বিট কর্মকর্তা খন্দকার আরিফুল ইসলাম ও রেঞ্জ কর্মকর্তা আবুল হাসেম আর্থিক সুবিধা নিয়ে কোন ব্যবস্থা নেননি।
বন বিভাগের জবর দখল তালিকায় দেখা যায়, ডা. ইকবালের বেন্টলীর বিরুদ্ধে ২০০৭ সালে উচ্ছেদ মামলা করা হয়েছে। স্থাপনা হিসেবে শুধু বাউন্ডারি ওয়ালের কথা উল্লেখ আছে। তথ্য হালনাগাদ করা হয়নি।
একজন বন কর্মকর্তা বলেন, বনভূমি দখল হলে প্রতিরোধ না করে শেষে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে উচ্ছেদ মামলা জমা দিয়ে দায় এড়ানোর প্রবণতা বেড়ে গেছে। এসব মামলা বছরের পর বছর ঝুলে থাকে, সহজে কিছু হয় না। ওই ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি স্থাপনা উচ্ছেদ ও বনায়ন করা জরুরি।
এ ব্যাপারে গ্লোবাল ফিটের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও বক্তব্য নেওয়া যায়নি।
জানতে চাইলে অভিযুক্ত মোনায়েম হোসেন ঘটনার আড়ালের কাছে দাবি করেন, তিনি একবার খবর পেয়ে বাধা দিয়েছিলেন। তার সময়ে কোন কাজ হয়নি।